ছায়াপথ
ছায়াপথঃ অস্থির
সময় ও উত্তরণ
আমার
আলোচিত
“ছায়াপথ” গল্পটি শিলচরের ‘ঈশান’ পত্রিকায় প্রকাশিত, ২০১৭ সালের অক্টোবরের ২৯বর্ষঃ প্রথম সংখ্যায়। লেখিকা উত্তরপূর্বের
শিলচরের স্বনামধন্য স্বপ্না ভট্টাচার্য। তার লেখায় সমাজবাস্তবতা খুব সুক্ষ্ম ভাবে উপস্থাপিত। উপস্থাপনার ভঙ্গি সহজ এবং খুব গভীর। আমার আলোচিত ‘ছায়াপথ’ গল্পের আখ্যান একমুখী
কিন্তু জীবনের খণ্ডাংশকে সহজেই ব্যাঞ্জিত করে। ‘ছায়াপথ’
শুধু ছায়ায় আবৃত পথ নয়। সেটি মানুষের কাছে মানুষের অবলম্বনের পথ। একে অপরের প্রতি আস্থা
রাখার পথ। একে অন্যের সঙ্গে নতুন করে চলার পথ। একে অপরের উপর নির্ভর যোগ্যতা এবং পরিপূরক থাকার পথ, নতুন করে
বাঁচার পথ, স্বপ্ন দেখার পথ।
গল্পটি একবিংশ শতকের সমাজ পরিবেশে রচিত। স্থান কাল পাত্র ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এক
বিস্তীর্ণ অঞ্চল। অস্থির যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে প্রত্যেকটি চরিত্র জীবন যাপন করে। যে যুগে স্যোসিয়াল মিডিয়া, ডিজিটাল যন্ত্র
মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে, সে যুগের প্রতিনিধিরা নিজেদের ছোট ছোট স্বার্থ পূরণে
ব্যস্ত হয়ে পরেছে। তাদের ব্যস্ততার কারনে তাদের হৃদয়ে থাকা সহজ সরল সুন্দর চেতনা
গুলো হারিয়ে যেতে বসেছে।
একবিংশ শতক দ্রুততার শতক। এই সময় অস্থিরতা আর শুধু
এগিয়ে যাওয়ার তাগিদ আছে।
অস্থিরতা আছে কিন্তু সমাজের উপলব্ধি করার ক্ষমতা নেই। ফলে মানবিক-সামাজিক মূল্যবোধগুলো
হারিয়ে যাচ্ছে।
প্রত্যেকটি মানুষ সম্পদশালী হলেও তারা একাকীত্ব জীবন যাপন করে। তারা একে অপরের
থেকে আলাদা হয়ে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হয়েছে।
“সময়টা বড় অস্থির, বিপন্ন
আমি
এবং বিপন্ন তুমিও, আমরা সবাই ।
অস্থির এই সময়ে আমি, তুমি এবং
আমাদের যা কিছু স্বকীয়তা সব
প্রশ্নের মুখে” ।
এবং বিপন্ন তুমিও, আমরা সবাই ।
অস্থির এই সময়ে আমি, তুমি এবং
আমাদের যা কিছু স্বকীয়তা সব
প্রশ্নের মুখে” ।
ধীমান বসাক
প্রত্যেকে একাকীত্বের
অসুখে ভুগে।
ইন্দ্রজালের সাহায্যে মুঠোফোনে প্রত্যেকে কাছাকাছি আসলেও মুঠোফোনের মাধ্যমে
কাছাকাছি আসলেও তারা যেন একা। আত্মসুখ
যুগের এক বড় সুখে পরিণত হয়েছে।
গল্পে বর্ণিত সোহিনী ও বিরাজ এই সময়ের বিধ্যস্ত প্রতিনিধী। সোহিনী বিরাজকে কেন্দ্র করে সংসার যাত্রা শুরু হয়। সে সংসারে আত্মতৃপ্তি থাকেনা। অতৃপ্ত কামনা বাসনা থেকেই সোহিনী শিবায়নকে
ফোন করে,
কিছুটা হলেও আত্মসুখ খুঁজে পূর্ব স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে। বিরাজ, সোহিনী এবং শিবায়নের টাকা পয়সার অভাব না থাকলেও মানসিক শান্তি নেই। তারা একে অপরের প্রতি বিতৃষ্ণার ফলে
মানবিক-সামাজিক মূল্যবোধগুলি হারিয়ে ফেলে একাকীত্বে পরিণত হয়। কিন্তু গল্পকার এই যুগের একাকীত্বের অসুখে ভোগা, আত্মতৃপ্তির ম্যানিয়ায় পরিণত হওয়া এইসব যুবক যুবতীদের শেষমেষ উত্তরনের পথ
দেখিয়েছেন। নতুন
করে পথের সন্ধান দিয়েছেন।
মানবিক সামাজিক মূল্যবোধগুলির জাগরনের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকার গল্প শুনিয়েছেন।
গল্পটি শুরু হয় নাগরিক বাতাবরণে এক নিঝুম রাতে। রাতের নিঝুমতার মতোই সোহিনীর জীবন অতিবাহিত হয়। ১৪ বাই ১৪ ফুটের ঘরে ঘাটের উপর
নিস্তব্ধ সোহিনী। বারো
বছরের বিবাহিত জীবনে কোন অভাব নেই। একটি
সন্তানও তাদের রয়েছে। তারা
দুজনেই ইঞ্জিনিয়ার। সিকিম
মনিপালএ পড়াশোনা করে। এখন
কলকাতায় চাকরি করছে। তারা
প্রত্যেকে ইঞ্জিনিয়ার, টাকা পয়সায় পরিপুর্ণ বিত্তশালী যুবক-যুবতি কিন্তু তেতলার
সেই ১৪ বাই ১৪ ফুটের ঘরে অস্বস্তিতে জীবন যাপন করে। বারো বছর সংসার করেও মানবিক
মূল্যবোধের অভাবে তাদের অভাবহীন সংসারে সম্পর্কের অভাব দেখা দেয়। আন্তরিক
ভালোবাসার অভাব দেখা দিয়েছে।
জীবনের সব নষ্ট হয়ে গেছে, বেঁচে থাকার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। “দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে উদাস ভাবে অন্ধকারে বসে থাকি
সোহিনী” কারন “বিয়ের দু-বছর যেতে না যেতেই সুর-তাল-লয় কেটে গেল! এলিয়ে পড়ল সব!
সিকিম মনিপালের ভালোবাসার ঢেউ আছড়ে পড়ল মহানগরীর কংক্রিটের জঙ্গলে। এলোমেলো হয়ে গেল সব”। তাই সোহিনী ফোনে ধরেছে শিবায়নকে। শিবায়ন তার বন্ধু হয়।
তবে বন্ধু বলা যায় না, একসময়ের জীবনেরও বন্ধু বলা যায়। কিন্তু ভাগ্যের চক্রান্তে
চার হাত এক হয়নি সেটা আলাদা কথা, সময় তাকে সায় দেয়নি। তবে মাঝে মাঝে আবেগে
আনুরাগে পূর্ব স্মৃতিতে ফিরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষাও রাখে।
নাগরিকতার উদ্ভ্রান্ত জীবনে সবাই সমস্ত কিছুর সমাধান
খুঁজতে চায় আর নিজেকে আরো আধুনিক দেখাতে গিয়ে বেশির ভাগ যুবকই মদের নেশা মত্ত হয়।
বিরাজ ইঞ্জিনিয়ার, সম্পদের অভাব নেই তাই বিতৃষ্ণা ও বেদনা ভুলতে ড্রিংকস করে। এই কারণে সোহিনী
তাকে ‘মাতাল’ বলে। আসলে সময়ের দাবি অনুযায়ী
প্রায় প্রত্যেক যুবক নেশা করে। বিরাজও তার বযতিক্রম নয়। সেই মাতাল
স্বামীর সঙ্গে সংসার করতে গিয়ে সোহিনীকে কখনো কখনো স্বাধীন পথে চলতে হয়েছে। এর ফলে
বিরাজের কাছে শিক্ষিতা চাকুরীরতা স্ত্রী স্বেচ্ছাচারী হয়ে গেছে। সে স্বাধীন ও
বিকল্প পথে চলতে চায় বলে বিরাজ তাকে এড়িয়ে চলে। এইভাবে তাদের সংসারে এক চরম বিপর্যয় নেমে আসে।
কঠিন সময়ের সংকটময় পরিস্থিতিতে শিবায়ন এর প্রবেশ
অপ্রত্যাশিত ছিলনা।
প্রত্যাশিতই ছিল কারন সে তাদের পূর্ব পরিচিত। সম্পর্কে বন্ধু।
কখনো “মনের মধ্যে সোহিনী পূরবী হয়ে বাজে। বেজেই চলে। ওর আয়ত চোখের কোণে অশ্রু বিন্দু যেন দেখতে পায় শিবায়ন”। সমকালীন অস্থির, বিপর্যস্ত সামাজিক
কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে লেখিকা প্রবৃত্তি বন্ধুত্বের এই পরিবর্তিত মূল্যবোধকে
প্রত্যক্ষ করেছিলেন লেখিকা।
প্রবৃত্তির তাড়নায় বন্ধুত্বের পরিবর্তনশীল মূল্যবোধের পরিচয় দিলেও শিবায়ন নিঃস্বার্থতার
পরিচয় দেয়। আবেগ অনুরাগ প্রবৃতির বিপরীতে শিবায়ন উদারতার সন্ধান দেন। তাই শিবায়ন নির্দ্বিধায় বলে “আগামী ২৫ জুনের
টিকিট ডাউনলোড কর। পরশু থেকে
আমি কদিন ফ্রি রেখেছি। তুই বিরাজকে
নিয়ে চলে আয়”। তাতে
লেখিকা সমকালীন বন্ধুত্বের অবক্ষয়িত মূল্যবোধের উপর দাঁড়িয়ে সম্পর্কের অনিবার্য
টান বা আকর্ষণকে এক রোমান্টিক অনুভূতিতে রূপ দান করে। এয়ারপোর্টের লাউঞ্জ থেকে বেরিয়ে আসতেই বিরাজকে জড়িয়ে ধরে
শিবায়ন। সোহিনী কিছুটা দূরে- শ্লথ পায়ে এগোচ্ছিল। ... শিবায়ন বিরাজকে ছেড়ে সোহিনীর
দিকে এগিয়ে যায়”।
বাস্তব সমাজ
জীবনে জীবনে বন্ধুত্ব এক পবিত্র সম্পর্ক। মূল্যবোধের দিক
থেকে এই সম্পর্কে কোন স্বার্থ থাকেনা, লোভ-লালসা থাকেনা, থাকে শুধু হৃদয়ের সংগীত হৃদয়ের মিলন। একে অপরের
সহযোগিতা, সাহস ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার
প্রেরণা। সোহিনীর প্রতি শিবায়নের উষ্ণ টান থাকলেও সোহিনীর প্রতি তার সাহচর্য ও অবিচ্ছিন্নতাই দেখাতে চেয়েছিলেন লেখিকা। মনে কামনার উদ্দীপনা
থাকলেও বন্ধুর টানে পবিত্র সাহচর্যের প্রতি সাড়া দিয়ে
তাদের দু’জনকেই ডাক দিয়েছে শিলচরের। সোহিনী আর যাতে সুখে থাকতে পারে তার জন্য অশেষ চেষ্টা করে দেখতে চেয়েছে।
সে “বিরাজকে কাছে টেনে
নেয়। অব্যক্ত ব্যাথায় বুক মুচড়ে
ওঠে। বিরাজ শিবায়নের কাঁধে মাথা রাখে। শিবায়ন
টের পায় উদগত কান্না বিরাজের শরীরের তরঙ্গ ছড়িয়ে দিচ্ছে। মৃদু কাঁপন টের
পায় শিবায়ন। বিরাজকে
আরো কাছে টেনে নে ও”।
নাগরিকতার প্রেক্ষাপটে লেখিকা মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের
চিত্রকে চিত্রায়িত করলেন বিরাজ সোহিনীর দোলাচাল সম্পর্কের মধ্য দিয়ে। গ্রাম থেকে উঠে আসা কলকাতার নতুন নাগরিক হওয়ার সুবাদে যে মানসিকতার অধিকারী হয়, তা বর্তমানে সম্পদশালী নীতি
বর্জিত মানব সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে।
উনিশ শতকে সামাজিক সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে
নারী জাগরণের আন্দোলন হয়, তাতে নারীদের সমস্ত কুক্ষিগত ধারণা
ভেঙ্গে যায় নারীরা শিক্ষিত হতে থাকে। বিশশতকে এসে শিক্ষার
আলোয় আলোকিত নারী অনেকটাই মুক্তির আস্বাদ পায়। এই গল্পের
নারী সোহিনী একবিংশ শতকের সেই নারী জাগরণের পথ বেয়ে শিক্ষিত
এবং চাকুরিরতা।
সে স্বাবলম্বী। সে নিজেকে স্বাধীন বলে মনে করে। বোঝা যায় সে স্বেচ্ছাচারী, কিন্তু সোহিনী তা নয়। এটা বিরাজের মনের ভুল। সে স্বাধীন কিন্তু ভালোবাসার উচ্চাকাঙ্ক্ষী। একবিংশ
শতকের বিভ্রান্ত যুবক-যুবতীরা নিজেদের স্বার্থ ও লক্ষ্য
পূরণে ব্যস্ত থেকে একে অপরের মনের কথা বুঝতে পারে না। একে
অপরকে বোঝার ক্ষমতাও রাখে না। ফলে
সংসার যাত্রা ভঙ্গ হয়। বিশ্বাসের ভিত নষ্ট হয়ে সন্দেহের ভিত মজবুত হয়। তাই নিজের বিবাহিত স্ত্রীকে বিরাজ “স্বেচ্ছাচারী পাজি”
বলতেও দ্বিধা করে না, কিন্তু গল্পের আসল রং বদলে যায় গল্পের
দ্বিতীয় পর্যায়ে মামিবাড়িতে। মামি বাড়িতে দেবদূতের মতো শিবায়ন পরামর্শ দিয়েছে- “তুই মানিয়ে চল বিরাজ। কোথাও
তোর ত্রুটি আছে। নিজেকে জিজ্ঞেস কর। ওর অনেক কিছু তোর ভালো নাও লাগতে পারে। ….. তাই বলে
গালাগালি দিবি? নাহ! এটা হয় না। সোহিনী কেন মেনে নেবে? অনেকবার তোকে বলেছি- ওর একটা আত্মসম্মান আছে”।
একবিংশ শতকে বিশ্বাসহীনতার সময়। “দিশেহারা, উৎকণ্ঠা ও স্বপ্নসংকটাপন্ন ব্যক্তির যন্ত্রণা এসময় স্থান পায়”। ফলে এতদিন ধরে চলে আসা বাঙালি জীবনে
নর-নারীর দাম্পত্য সম্পর্কে এক বড় আঘাত লাগে। এই সময়
প্রথাগত নিয়মে দাম্পত্য জীবন শুরু করেও মানবিক দিক থেকে বিকৃত হয়ে ওঠে। যন্ত্রণাদগ্ধ দাম্পত্যের রক্তাক্ত ক্ষত-বিক্ষত
জীবনের প্রতিটি পর্ব প্রতিফলিত হতে থাকে। সাহিত্যেই সেই যন্ত্রণাবিদ্ধ দাম্পত্য সম্পর্ক প্রতিবিম্বিত হয়। প্রথাগত নিয়মের বাইরে, বাইরের সম্পর্ক বিকৃত হয়ে
যায়। অভিনয়টাই এই যুগে মুখ্য হয়ে ওঠে।
“ছায়াপথ” গল্পে লেখিকা বিরাজ সোহিনীর মধ্য দিয়ে যে দাম্পত্য
সম্পর্ক তুলে ধরার চেষ্টা করলেন, তা সমাজ বিবর্তনের ধারা
অনুযায়ী আসেনি। সময়ের দাবি মেনে একে অপরে মিলিত হয়েছে। তবুও
তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলি দাম্পত্য সম্পর্কের ঘনিষ্ঠ অন্তর্লোকে মিলিত হতে চেয়েছে। সোহিনী বিরাজের প্রাথমিক দাম্পত্য সম্পর্কে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলেও সমাজের শৃংখলার নামে আবদ্ধ থাকাটাকেই লেখিকা গুরুত্ব দিয়েছেন। আর কটাক্ষ করেছেন আবেগ উৎসাহীন নিয়মানুবর্তিতাকে।
এই কারণে সোহিনীর কাছে বারবার সম্পর্কের দৃঢ়
বাঁধনে ভালোবাসা ও ভালো লাগাটাই বড় হয়ে উঠেছে। সুখে-দুখে দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ থেকে দিন যাপন করার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছে। কিন্তু যখন সে বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছে তখনই সে
বেপরোয়া হয়ে পূর্বপরিচিত বন্ধুর সহযোগিতা বা আশ্রয় নিয়েছে।
সমগ্র বিশ্বে একবিংশ শতক একটি সংকটের সময় উপস্থিত
হয়। এই সময়ে সমাজের পরিবর্তন লক্ষণীয়ভাবে ধরা পড়ে। মূল্যবোধগুলো
অবক্ষয়িত অবস্থায় শুধু টিকিয়ে থাকে প্রদীপের শেষ বাতির মত করে। নাগরিক সমাজ
মূল্যবোধের অবক্ষয়ের হাত ধরে বিশ্বাসহীনতায় পতিত হয়। নাগরিক
সমাজের বিশ্বাসহীনতায় বিপন্ন যুবক বিরাজের হাত ধরে সমগ্র যুবককে
উত্তরণের পথ দেখিয়েছে।
সময়ের অস্থিরতা বিরাজকে অস্থির দিশাহীন করে তুলেছে। নগরের কংক্রিটের জঞ্জাল থেকে সরে এসে বিজনঘন গ্রামে যখন প্রবেশ করে, সেই সময়েই বিরাজের সম্বিৎ ফিরেছে। দাম্পত্য জীবন কি? এবং কেমন হওয়া উচিত? সেটা বুঝতে পেরেছে। একদিকে নগর জীবনের অত্যাধিক
অস্থিরতা অন্যদিকে ইন্টারনেটহীন প্রত্যন্ত
গ্রাম্য জীবন। যেখানে “ফোকলা দাঁতের
হাসিতে হীরে মানিক হাসে”। জনহীন গ্রাম্য পথ ধরে গ্রামের মোহময় রূপের আড়ালে বিরাজ জীবনের আসল মানে বুঝতে পারে।
“মার্কেটিং
আর মার্কেটিং! এত চাপ! টার্গেট বেড়েই যাচ্ছে। এ যেন
খুড়োর কল! কোথায় এর শেষ! ওই পাখা মেলে দিয়ে আকাশে একটা পাখি ঘুরপাক খায়।
বিরাজের চোখ আটকে থাকে”।
বিরাজ, সোহিনী ও শিবায়ন সমাজের ঘাত-প্রতিঘাতে তারা
তাদের জীবন অতিবাহিত করে। তাদের মধ্যে দিয়ে সময়ের দ্বান্দ্বিক
পরিস্থিতি ও সমাজ বাস্তবতা প্রতিফলিত হয়। তাই
বিজনঘন মামি বাড়িতে
“এক অদ্ভুত বিপন্নতার মুখোমুখি সোহিনী আর বিরাজ”। সার্বিকভাবে বিরাজ বিশ্বাস হারিয়ে সোহিনী থেকে
মানসিকভাবে অনেক দূরে চলে গেছে। তাই বিজনঘন গ্রামে সোহিনীর সঙ্গে থেকেও সে অনেক দূরে অবস্থান করে। কিন্তু
শিবায়ন এর চেষ্টায় মামি বাড়িতে “বহুদিন পর বিরাজও স্বাভাবিক। ঠিক বিয়ের পর যেমন করত! সোহিনী মাছ ভালোবাসতো বলে প্রায়ই নিজের থালা থেকে মাছ তুলে সোহিনীকে দিয়ে দিত”। সেই ভালোবাসার হাত ধরেই “সোহিনী
তার কাঁধে একটা কোমল বলিষ্ঠ হাতের ছোঁয়া টের পায়”। সেই
বলিষ্ঠ হাতের ছোঁয়া আবার নতুন করে
চলার পথ দেখায়। নতুন করে বাঁচার উৎসাহ, প্রেরণা যোগায়। এইভাবে একবিংশ শতকের যুবক-যুবতীরা নিজেদের দাম্পত্য জীবনের অসুখী
অস্থিরতা থেকে নিজেদের বের করে আনার চেষ্টা করে। এগিয়ে আসে
সংগ্রামে ব্রতী হয় একে অপরের কাঁধে হাত রেখে এগিয়ে যাওয়ার।
**************************
সহায়ক গ্রন্থাবলীঃ
১. ঈশান, সাহিত্যঃ সম্পাদক- অমিতাভ সেনগুপ্ত,
সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকা, ২৯ বর্ষ, ১ম সংখ্যা, আশ্বিন ১৪২৪ বঙ্গাব্দ, অক্টোবর
২০১৭ খ্রিস্টাব্দ, শিলচর সানগ্রাফিকস, উল্লাসকর দত্ত সরণি, শিলচর, ৭৮৮০০১২।
২. বাংলার সামাজিক ইতিহাস ধারা (১৮০০-১৯০০) সইফুর
রহমান চৌধুরী, বাংলা বাজার, ঢাকা-১১০০, ১৯৬৮।
৩. উজাগরঃ সম্পাদনাঃ উত্তম পুরকাইতঃ নরেন্দ্রনাথ
মিত্র সংখ্যা, সাহিত্য সংস্কৃতি বিষয়ক সান্মাষিক, দশম সংখ্যা, প্রথম সংখ্যা ১৪১৯, উলুবেড়িয়া,
হাওড়া।
ড. পরিতোষ রায়
No comments