ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের ললিত ও লাবণ্যঃ একটি বিশ্লেষণী অধ্যয়ন (প্রথম পর্ব)
প্রথম পর্ব
*************************************************************************
এক.
বাংলা সাহিত্যের রঙ্গ কৌতুকের রাজা ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় ২২ জুলাই ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান উত্তর ২৪ পরগনার শ্যামনগরের কাছে বাহুতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ঈশ্বর মুখোপাধ্যায়। ত্রৈলোক্যনাথ শৈশব থেকেই সংগ্রামী ছিলেন তার জীবনের দরিদ্র-দুঃখ-কষ্টই তাকে সংগ্রামী করে তুলেছে। সমাজ জীবনকে চিনিয়েছে। সেই অভিজ্ঞতাকেই ত্রৈলোক্যনাথ নানাভাবে রসিকতায় সাহিত্যে প্রকাশ করেন এবং সমাজের অসংগতিকে আঘাত করতে সক্ষম হন।
সাংসারিক অভাব-অনটনের কারণে ত্রৈলোক্যনাথের শিক্ষা জীবন ততটা সচ্ছল ছিল না। চুঁচুড়ার ডাফ সাহেবেরও তেলেনি পাড়ার স্কুল থেকে অষ্টম পাস করেই প্রথাগত শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করেন। জীবন-জীবিকার টানে ১৮৬৫ সালে বাড়ি থেকে রোজগারের জন্য বেরিয়ে পড়েন প্রথমে বীরভূমের দ্বারকাপারে বীরগঞ্জের উখড়া গ্রামে শিক্ষকতা করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তারপর রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে সাজাদপুরে নিয়ে আসেন। সেখানে ২৫ টাকা মাসিক বেতনে শিক্ষকতা করেন।
উৎসাহী ও কৌতুহলী  ত্রৈলোক্যনাথ একজায়গায় বসে কাজ করতে পারেননি। তাই জীবিকার টানে করে যাওয়া কাজে তেমন মন বসাতে পারেননি। তাই কাজ ও জায়গা পছন্দ না হওয়ায় চলে যান ওড়িষ্যায়। ১৮৬৮ সালে কটক জেলা পুলিশ সাব ইন্সপেক্টর পদে নিযুক্ত হন। সেখানে বসবাসসুত্রে উড়িয়া ভাষা শেখেন এবং সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। “উৎকল শুভঙ্করি” নামে উড়িয়া ভাষায় প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তাঁর অসামান্য দক্ষতা বিচক্ষণতা ও কৌতুহলী মন মানসিকতা দেখে স্যার উইলিয়াম হান্টার সাহেব কলকাতা বেঙ্গল গেজিটিয়ার সংকলন কার্যালয়ের সেকেন্ড লিটারেরি অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে নিযুক্ত করেন। পরে সেখানে তিনি হেড করণিকের পদে উত্তীর্ণ হন।
তাঁর সাহিত্য সাধনা যেমন বিচিত্র তেমনি তার ব্যক্তিগত জীবনও বৈচিত্র্যময়। ব্যক্তি জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনা, সে থেকে সঞ্চয় করা অভিজ্ঞতাই সাহিত্য সাধনাকে বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে। ভারত সরকারের সহযোগিতায় ইউরোপের নানা দেশে ভ্রমণ করেন। ইউরোপে থাকা কালীন সেদেশের অভিজ্ঞতাকে ত্রৈলোক্যনাথ লিপিবদ্ধ করে লিখলেন “A Visit to Europe” এছাড়াও ১৮৮১ সালে ভারত সরকারের রাজস্ব বিভাগে ও ১৮৮৩ সালে কলকাতার আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে কয়েকটি বিষয়ের অধ্যক্ষ হিসেবে সাফল্যের সঙ্গে কাজ করে বাংলা তথা ভারতবর্ষের একটি জনপ্রিয় মুখে পরিণত হন। হান্টার সাহেব ইউরোপ চলে গেলে ত্রৈলোক্যনাথ উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের কৃষি ও বাণিজ্য বিভাগের প্রধান করণিকের পদে যোগ দেন। তার যথেষ্ট প্রচেষ্টা ও উদ্যমে কাজের ১৮৮৭ সালে রায়বেরেলি ও সুলতানপুর দুর্ভিক্ষকে প্রতিহত করা সম্ভব হয়েছে। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ভারত সরকারের অনুমতি নিয়ে দেশীয় শিক্ষা বাণিজ্যে যাতে উন্নতি হয় তার যথেষ্ট চেষ্টা করেন। তাই ভারত সরকারের অনুমতিতে দিলেন “Art Manufactures of Second” নামে একটি বই। সেখানে ভারতের নির্মিত সব শিল্প দ্রব্যের নাম ইংরেজিতে প্রকাশ করেন।
ত্রৈলোক্যনাথের ব্যক্তিগত জীবন বৈচিত্রে পরিপূর্ণ, সে স্থির নয় আবার অস্থিরও নয় ধাপে ধাপে বিবর্তন ও উন্নয়নশীল বলা যায়। তিনি বাংলা সাহিত্যে একপ্রকার উদ্ভট হাস্যরসের প্রবর্তন করেন। আপাতদৃষ্টিতে তা উদ্ভট মনে হলেও সেসব ছিল সমাজেরই প্রতীক চিহ্ন। তিনি সরাসরি বলতে না পেরে রূপকের আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। যেমন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় তার “বাংলা গল্প বিচিত্রা” তে বলেছেন- “রঙ্গ ও রসিকতার উপকরণে ত্রৈলোক্যনাথ আত্মসমালোচনা করেছেন সেই আত্মনিরীক্ষার দর্পণে দেশের অনেক অনেক গ্লানি; অনেক ভণ্ডামি; অনেক মিথ্যাচার প্রতিবিম্বিত হয়েছে”।১ তাঁর রচিত ‘কঙ্কাবতী’ (১৩০০) ‘সেকালের কথা’(১৩০১) ‘ভূত ও মানুষ’ (১৩০৪) ‘ফোকলা দিগম্বর’ (১৩০৭) ‘মজার গল্প’ (১৩১১), ‘পাপের পরিণাম’ (১৩১৫), ‘ডমরু চরিত’ (১৩৩০) প্রভৃতি গল্প উপন্যাস গুলি শুধু বাংলা সাহিত্যেই নয় বিশ্ব সাহিত্যেও যথেষ্ট খ্যাতি লাভ করে।
সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের সার্থক উত্তরসূরী হলেন ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়। তবে ভাষারীতির দিক থেকে বঙ্কিমরীতিকে সরাসরি গ্রহণ করেননি। তিনি প্রমথ চৌধুরীর মতো লৌকিক ভাষারীতিকে গুরুত্ব দিয়ে গল্প শোনাতে চেয়েছিলেন বৈঠকি চালে। তিনি শ্রোতাদের গল্প শুনিয়েই শুধু ক্ষান্ত থাকেননি। গল্পের শেষে আরও কিছু বলতে চান, যার মধ্যদিয়ে শ্রোতারা নীরবে গল্পটিকেই আত্মস্থ করে ফেলে। তাকে পরিষ্কার করে বলতে হয় না কারণ “ত্রৈলোক্যনাথের ব্যক্তি ও কর্মজীবন বাস্তব জীবনের করুণা, সুখ-দুঃখের সহমর্মিতা ইত্যাদি মানবিক বোধে এমনভাবে গড়ে উঠেছিল, যা তাঁর শিল্পপ্রয়াসে গভীর ছায়াপাতে সক্রিয় থেকেছে। তার গল্পগুলি যে মানবিক মঙ্গলবোধ, আদর্শ চিন্তা, মানবতাবাদের পরিশীলনে অন্যদের থেকে সাহিত্যমূল্যে স্বতন্ত্র আসন পায়, তাঁর কারণ শিল্পী লোলোক্যনাথের বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি”।২
দুই.
অরুণ কুমার মুখোপাধ্যায় ‘কালের পুত্তলিকা বাংলা ছোটগল্পের একশ বিশ-২০১০’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘ত্রৈলোক্যনাথের গল্প-সংকলন চারটি- ভুত ও মানুষ (১৮৯৭), মুক্তামালা (১৯০১), মজারগল্প (১৯০৪), ডমরুচরিত (১৯২৩; মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়) গত শতকের শেষ দশক থেকে শুরু করে প্রথম বিশ্ব সমর পর্যন্ত সময়সীমার মধ্যে। চারটি সংকলনের গল্পের মোট সংখ্যা ত্রিশ’।৩
‘ললিত ও লাবণ্য’ গল্পটি ‘মুক্তামালা’ গল্পের অন্তর্গত। গল্পটি পাঁচটি পরিচ্ছেদে ১৯০১ সালে প্রকাশিত হয়। তবে লেখকের মৃত্যুর পর গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ বের হয় ১৯২৪ সালে। সেই গ্রন্থে প্রকাশক লিখেছেন, “বঙ্গের প্রসিদ্ধনামা লেখক পরলোকগত ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় মহাশয় প্রায় তেইশ বৎসর পূর্বে বঙ্গবাসীতে প্রকাশিত তাহার আদূরি ও আরসী প্রভৃতি এগারোটি গল্প একত্র করিয়া ‘মুক্তামালা’ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন। এই গ্রন্থে গল্পগুলি খাপছড়াভাবে প্রকাশিত না করিয়া একটা মূল রচনা করিয়া তাহার মধ্যে ঐ এগারোটি গল্পের অংশ রূপে সন্নিবিষ্ট করেন’’।৪ এই গ্রন্থের গল্পগুলিতে হাসি ঠাট্টা ও রঙ্গ-রসিকতার পরিমান কম ছিল। কল্পনার চেয়ে বাস্তবের ছবিটাই স্পষ্ট। এই কারনে গল্প রচনায় রবীন্দ্র সমসাময়িক হলেও রবীন্দ্রভাবনাকে তেমনটা পাত্তা দেননি। রবীন্দ্রভাবনার প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ককে গুরুত্ব না দিয়ে মানুষ ও মানুষের জীবন দর্শনকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিলেন। ব্রিটিশ শাসিত সমাজব্যাবস্থায় বিভ্রান্ত মানুষ পথ খুঁজে না পেয়ে দিশেহারা। সেই দিশেহারা মানুষের খোঁজে ত্রৈলোক্যনাথের গল্প লেখা।
তিন.
“ললিত ও লাবণ্য” ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের “মুক্তামালা” গল্পগ্রন্থের অন্তর্গত। গল্পটি পাঁচটি পরিচ্ছেদে রচিত। প্রথম পরিচ্ছেদের নাম ‘প্রাইজের পুস্তক’, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের নাম ‘মেয়ের হাতের বালা’, তৃতীয় পরিচ্ছেদের নাম ‘এখন হইতে ভালো হইব’, চতুর্থ পরিচ্ছেদের নাম ‘মা তুমি না খাইলে, আমি খাইব না’ এবং পঞ্চম পরিচ্ছেদ এর নাম ‘একবার উঠ বাবা’। পাঁচ পরিচ্ছেদে রচিত গল্পটি একটি পারিবারিক করুণ রসের গল্প। বাড়ির গৃহকর্তার শরীর ও মানসিক অবনতির মধ্যে দিয়ে পরিবারের প্রত্যেকটি চরিত্রের করুণ পরিণতি ঘটে। শেষ অবধি প্রত্যেকটি চরিত্রই প্রত্যেক পাঠকের সহমর্মিতা আদায় করে।
“ললিত ও লাবণ্য” গল্পটি সমাজের পারিবারিক গল্প। চারিত্রিক অবক্ষয়ে যে অশেষ লাঞ্চনার পরিস্থিতি তৈরি হয়, গল্পকার তাকেই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে যায়। এই গল্পে চারিত্রিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং মূল্যবোধ ফিরিয়ে পাবার মধ্য দিয়ে জীবনের ক্রম পরিণতির গল্প আছে। স্বামী-স্ত্রীসহ সাত বছরের একটি ছেলে এবং পাঁচ বছরের মেয়েকে নিয়ে এই পরিবার। গল্পের শুরুতেই জানা যায় পরিবারটিতে সুখ বলে কোন জিনিসের অস্তিত্ব ছিল না। কারণ পরিবারের গৃহকর্তা নেশাখোর। সাত বছরের ছেলে স্কুলে ভালো ফল করেছে আর ভালো ব্যাবহার করেছে বলে বই পুরস্কার পেয়েছে। সেই বই পাওয়াকে কেন্দ্র করে লাবণ্য ও তার মা আনন্দিত হয়। কিন্ত ললিত তার পিতাকে বই দেখাতে সাহস পায় না।ললিত এবার পণ করে মাকে বলে উঠে-“মা! বইগুলি বাবাকে দেখাইবো? কিন্ত মা, ভয় করে।আর সকলের বাবা ছেলেদের আদর করেন। কিন্তু আমাদের বাবা কেবল বকেন কেন, মারেন কেন, মা?কিন্তু মা! যা থাকে কপালে, কেবল আজ আমি তাহাকে প্রাইজের বইগুলি দেখাইব”।৫ ছেলের এইরকম প্রতিজ্ঞার কথা শুনে মায়ের চোখে জল আসে। মায়ের কান্না দেখে লাবণ্যও কেঁদে ফেলে। সন্ধ্যার সময় তার পিতা বাড়িতে আসলে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলে- “বাবা আজ আমি প্রাইজ পাইয়াছি, এই বইগুলি পাইয়াছি”।৬ তৎক্ষণাৎ তার পিতা রেগে যায়। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে বইগুলি রেখে যেতে বলে। সেই বইগুলি বাজারে বিক্রি করে সে মদখায়। আর প্রতিদিনকার মত বাড়ির বাইরে রাত্রিযাপন করে।
ললিতের পিতার অনেক সম্পত্তি ছিল। নেশায় মগ্ন হওয়ার পর সব নিঃশেষ হয়ে যায়। এরফলে আসামে ভালো একটা কাজে থাকা ভাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া বিবাদ শুরু হয়। ললিতের কাকা ললিতের মাকে মাতৃরূপ স্নেহ করে। সে তাদেরকে ভুলতে না পেরে কিছু টাকা তার কর্মস্থল থেকে পাঠাতে থাকে। কিন্তু ভাইয়ের টাকা আসা সত্ত্বেও ললিতের পিতা অস্বীকার করে। সব টাকা নেশায় শেষ করে দেয়। ফলে তাদের পরিবারে বিপর্যয় নেমে আসে। সব সম্বল হারিয়ে খিদিরপুরে এক বিধবার বাড়িতে তাদের আশ্রয় নিতে হয়। সেখানেও তিন মাসের ভাড়া বাকি পড়ায় সেই বিধবা মহিলা তাগাদা দিতে থাকে। কিন্তু তারা নিরুপায়। ললিতের মাতা ভেবেছিল গহনা বেঁচে ভাড়া শোধ করবে, কিন্তু সে টাকাও তার পিতা কেড়ে নিল। সেই সুত্রেই ললিতের পিতা একদিন মেয়ের হাতের বালা খুলে নিয়ে চরম নিষ্ঠুরতা পরিচয় দেয়।
এই নিষ্ঠুর আচরণের পর কর্তাটিরও সুখ হল না। প্রতিদিন সে যেখানে রাত্রিযাপন করে সেখানে সে গয়না বিক্রি করে বিক্রি টাকা দিয়েছে সুখ ও আনন্দানুভূতি পাওয়ার জন্য। তার জন্যই সে স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে কষ্ট দিয়েছে। সেই তৃপ্তিদায়ক স্থানে, তৃপ্তিদায়ী ললনা যখন তাকে পরিত্যাগ করল, অপমান করল। ললিতের পিতা তখন খুবই শোকাহত হয়ে পড়ল। ওইদিন সন্ধ্যার পর নিঃশব্দে বাড়ি এসে শুয়ে পড়ল। পাশের ঘর থেকে ঘোৎ-ঘোৎ শব্দ শুনে ললিতের মা কর্তার পাশে এসে দেখে তার মুখ থেকে লালা ঝরছে। তৎক্ষণাৎ বাড়িওয়ালি বিধবাকে ডেকে তুলে সেবা-শুশ্রূষা করেছে। সকালে ডাক্তারকে ডেকে এনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। ডাক্টার বলে যায় সে আফিম খেয়েছে। পুলিশে খবর দিয়ে তাকে হাসপাতালে পাঠাতে হবে। পুলিশের খবর শুনে কর্তাটি তটস্থ হয়ে পড়ে এবং হাসপাতালে যেতে অসম্মত হয়। এর ফলে বাড়িতেই তাঁর চিকিৎসা চলতে থাকে। এভাবে সমস্ত দিন ধরে চলে সেবা শশ্রুষা। এরপর রাত্রি নয়টার সময় একটু সুস্থ বোধ করলে কর্তাটি সকলকে ডেকে বলেছিল- “দেখ আমি এতদিন অন্ধ ও পাগল হইয়াছিলাম। তোমরা আমাকে ক্ষমা কর”।৭ এই বলে কর্তাটি হাপাতে হাপাতে পরিবারকে এক চরম দুর্দশায় ফেলে রেখে পরলোকগমন করে। এদিকে অভাবের সংসারে ঘটিবাটি সব বিক্রি করে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করতে হল। পরিবারটি সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়ল।
ললিত কাঁচা হাতে কাকাকে পত্রে পিতার মৃত্যুর খবর জানাল। আরো জানাল যে তিন মাসের ঘর ভাড়া না পেয়ে বিধবাটি তাদের চলে যেতে বলেছে। এক নিরূপায় অবস্থায় পড়ে ললিতের মা পুত্র-কন্যাকে নিয়ে পিতার জ্ঞাতি নিষ্ঠাবান এক ব্রাহ্মনের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হয়। কিন্তু তারা তখনও অশৌচ থাকায় তাদের বাড়িতেও স্থান হয় না। এক অসহায় অসহনীয় অবস্থায় পড়ে তারা আবার খিদিরপুরে ফিরে আসে। সেখানে গিয়েও দেখে ললিতের কাকার কোন পত্র তখন অব্দি আসেনি। তারা পুনরায় গড়ের মাঠে গিয়ে উপস্থিত হয়।
একদিকে ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতর পুত্র-কন্যা অন্যদিকে অসহায় হয়ে ললিতের মাতা পাগলপ্রায়। কোন উপায় না দেখে পুকুরে পুত্র-কন্যা নিয়ে আত্মহত্যা করে। ঠিক ওই সময় শিয়ালদা থেকে ললিতের কাকা টাকা পয়সা নিয়ে তাদের কাছে রওনা দিয়েছে। যেতে রাস্তার পাশে পুলিশের তুলে আনা মৃতদেহ দেখে অবাক হয়ে পড়ে। পাগলের মতো মৃতদেহগুলিকে আঁকড়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।
চার.
জনৈক সমালোচকের ভাষায় “কালজয়ী নাট্যকার উইলিয়াম শেকসপিয়র একদা বলেছিলেন যে গোলাপকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন, সে সুন্দর। একথা সুগন্ধি কুসুমের ক্ষেত্রে সুপ্রযুক্ত হলেও সাহিত্যের আঙিনায় এর যথার্থতা সম্বন্ধে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়। বস্তুত সাহিত্যের নামকরণ এক পরম গুরুত্ব বিষয়। শিরোনামের দর্পণেই আভাষিত হয়ে ওঠে গল্পের বিষয়বস্তু ও মূর্ছনা। রবীন্দ্রনাথ নামকরণকে পরম গুরুত্ব দিতেন। যতক্ষণ না সেরা শিরোনাম খুঁজে পেতেন ততক্ষণ চলত তাঁর নিরলস গভীরতম অন্বেষণ”।৮ তাই সাহিত্যে নামকরণ অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে সাহিত্যে নামকরণ তিন ধরনের হয়ে থাকে-
১। রচনার বিষয়বস্তু কেন্দ্রিক
২। চরিত্র কেন্দ্রিক
৩। রচনার ব্যাঞ্জনা কেন্দ্রিক
তবে যেদিক থেকেই নামকরণ করা হোক না কেন, নামকরণ রচনার তাৎপর্যকেই ব্যাঞ্জিত করবে। কারণ সাহিত্যিক একটা লক্ষ্য স্থির করে তাঁর সাহিত্য রচনা করে। সেই সাহিত্যের লক্ষ্যকে ইঙ্গিত দেয় নামের মধ্য দিয়ে অর্থাৎ লেখকের রচনার তাৎপর্য নামেই ফুটে। সেটি চরিত্রকেন্দ্রিক নাম বা বিষয়বস্তু কেন্দ্রিক বা যে কোন ধর্মেরই হোক না কেন।
আমার আলোচ্য “ললিত ও লাবণ্য” গল্পের নামকরণ চরিত্র কেন্দ্রিককিন্তু সেই নাম গল্পের মূল বক্তব্যকেই ব্যাঞ্জিত করে এই নামের মধ্য দিয়ে। আসলে কোন নামে বিষয়বস্তুর ব্যঞ্জনা ছাড়া সার্থক হতে পারেনা। নামের মধ্য দিয়ে যদি বিষয়বস্তুর তাৎপর্য ব্যাঞ্জিত না হয়, সেই সাহিত্যের নামকরণ ব্যর্থ হয়ে যায়।
“ললিত ও লাবণ্য” গল্পে একটি পরিবারের করুণ কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। ললিতের পিতার অসামাজিক ব্যাভিচারী আচরণই পরিবারের বিপর্যয় ডেকে এনেছে। এক কথায় স্বামী-স্ত্রী-পুত্র-কন্যায় ভরপুর পরিবারে অসামাজিক গৃহকর্তা পরিবারটির ললিত ও লাবণ্যকে নিঃশেষ করে ফেলেছে।
ব্যাভিচারে আশক্ত পিতা পিতা পুত্রের পুরস্কারের বই বেচে মদ খায়। কন্যার হাতের বালা খুলে নিয়ে বাইরে রাত্রিযাপন করে। বাড়ির প্রতি তেমনটা টান নেই। বাড়ির সমস্ত কিছুই বেচে দেয়। ভাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া করেও সংসার চালানোর জন্য দেওয়া টাকাও আত্মসাৎ করে। তবে যেদিন বাইরে অপমানিত হয়ে নিজের ভুল বুঝতে পারে সেই দিনই সে আফিম খেয়ে কঠিন নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং মৃত্যু বরণ করে। তার অসামঞ্জস্যপূর্ণ কাজের জন্যই পরিবারটির ললিত ও লাবণ্য হারিয়ে গেছে। গৃহ কর্তার মৃত্যুতে ললিতের মা কোনো উপায় না পেয়ে পুত্র-কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে পুকুরে আত্মহত্যা করেছে।
‘ললিত’ শব্দের অর্থ হলো সুন্দর, কোমল আর ‘লাবণ্য’ শব্দের অর্থও তাই। লেখক  ত্রৈলোক্যনাথ সুকৌশলে নামটি ব্যবহার করেন। একটি পরিবার সতেজ সজীব থাকার পরিবর্তে গৃহকর্তার আচরণে পরিবারের সতেজতা, সজীবতা, সৌন্দর্যতা যেন শুকিয়ে গিয়ে নিঃশেষ হয়ে গেছে। অর্থাৎ পরিবারের কর্তার অস্বাভাবিক আচরণে ও মৃত্যুতে ললিতের মা এবং সহজ সুন্দর ছেলে-মেয়েটি নিজের ললিত ও লাবণ্যকে হারিয়ে ফেলেছে। বেঁচে থাকার উপায় এবং স্বপ্ন দেখার রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে। এইভাবে ‘ললিত ও লাবণ্য’ নামের মধ্যদিয়ে একটি পরিবারের স্বাভাবিকতা থেকে অস্বাভাবিকতায় করুণ পরিণতি হওয়ার ইঙ্গিত আছে। এককথায় ললিত ও লাবণ্য কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে সমগ্র গল্পটিকে এবং গল্পের তাৎপর্যকেও নিয়ন্ত্রণ করে। পাঠকের মনকে আঘাত করে করুন সাহিত্যরসকে জাগরিত করে।
************************************************************
No comments