স্বাদেশিকতা (দ্বিতীয় পর্ব) :: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- বড় প্রশ্নোত্তর। মান-৪/৫
প্রশ্নঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতৃদেব দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের
অনুপ্রেরণায় জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির স্বদেশপ্রেমের একটি মূল্যায়ন প্রস্তুত করো।
উত্তরঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতৃদেব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ
ঠাকুর স্বদেশের প্রতি একটা আন্তরিক শ্রদ্ধা পোষণ করতেন। ঠাকুরবাড়িতে অনেক বিদেশি প্রথার প্রচলন থাকলেও পরিবারের হৃদয়ের মধ্যে একটি
স্বদেশাভিমান বর্তমান ছিল। অন্তরের এই স্বদেশাভিমান
পরিবারের সকলের মধ্যে একটি প্রবল স্বদেশ প্রেম সঞ্চার করেছিল।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বাল্যকাল
থেকে অ্যাংলো হিন্দু স্কুল ও হিন্দু কলেজ প্রভৃতিতে ইংরেজি ভাষায় শিক্ষা লাভ করলেও
নিজের মাতৃভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি কোনোরকম হীন মনোভাব প্রকাশ করেননি। তারই
অনুপ্রেরণায় ঠাকুরবাড়িতে চিরকাল মাতৃভাষার চর্চা হতো। তিনি নিজে বিপথগামী যুবসমাজকে স্বদেশগামী করার জন্য ‘তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা’
স্থাপন করেন। এমঙ্কি কোন এক নতুন আত্মীয় তাঁকে ইংরেজিতে পত্র লিখলে সেই পত্র
তৎক্ষনাৎ ফেরত দিয়েছিলেন। ফলে তাঁর অনুপ্রেরনায়
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে নানা ধরনের স্বদেশপ্রেম মূলক অনুষ্ঠান হত। এই অনুষ্ঠানে ভারতবর্ষকে
স্বদেশ জ্ঞানে উপলব্ধি, ভক্তিভরে স্বদেশী সংগীত গাওয়া, দেশানুরাগের কবিতা পাঠ করা
হত।
এই ঠাকুরবাড়ির সাহায্যেই
হিন্দুমেলা সৃষ্টি হয়েছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ
ঠাকুরের উদ্যোগে স্বাদেশিকতার সভার সভাপতি ছিলেন রাজনারায়ণ বসু। গোপনে তাঁদের কার্যকলাপ আলোচিত হত। অন্যদিকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ভারতবর্ষে প্রচলিত দেশি পোশাক তৈরির বাসনায়
সর্বজনীন পোশাক তৈরি করেন। এছাড়াও স্বদেশের
কারখানায় দিয়াশলাই গামছা ইত্যাদি তৈরী করার চেষ্টা করেন। এইভাবে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির মধ্যে উনবিংশ শতক জুড়ে স্বাদেশিকতার এক
জোয়ার আসে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন এই জোয়ারের
প্রধান পুরুষ।
প্রশ্নঃ হিন্দু মেলা সম্বন্ধে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
উত্তরঃ হিন্দু মেলা ব্রিটিশ ভারতে হিন্দু সম্প্রদায়ের মনে স্বাদেশিকতার ভাব
জাগরণ তথা জাতীয় চেতনার প্রসারের উদ্দেশ্যে আয়োজিত একটি মেলা। এই মেলা জাতীয় মেলা ও স্বদেশী মেলা নামেও পরিচিতি লাভ করে।
১৮৬৭ সালের এপ্রিল মাসে ঠাকুর পরিবারের সহযোগিতায় কলকাতায় প্রথম হিন্দু মেলা
আয়োজিত হয়েছিল। রাজনারায়ণ বসু, দ্বিজেন্দ্রনাথ
ঠাকুর ও
নবগোপাল মিত্রের যৌথ উদ্যোগে প্রথম হিন্দু মেলার আয়োজন করা হয়। এই মেলার অপর
বৈশিষ্ট্য ছিল দেশীয় শিল্পোৎপাদনে উৎসাহ দান। এই জন্য এই মেলাকে বিংশ শতাব্দীর
প্রথমার্ধের স্বদেশী আন্দোলনের পূর্বসূরি বলে মনে করা
হয়। হিন্দু
মেলা কলকাতার বাঙালি সমাজের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনটি নির্দেশ করে। প্রথম
দিকের হিন্দু মেলা উদ্বোধিত হত চৈত্র সংক্রান্তির দিন। এই উপলক্ষে দেশাত্মবোধক
কবিতা ও গান লেখা হত। বাঙালি ও পাঞ্জাবি ছাত্রদের মধ্যে আয়োজিত হত কুস্তি
প্রতিযোগিতাও। থাকত হিন্দুদের কর্মদক্ষতা সংক্রান্ত নানা প্রদর্শনীর ব্যবস্থাও। মেলার প্রধান উদ্যোক্তা
নবগোপাল মিত্র চাইতেন সরকারের উপর দেশের জনসাধারণের নির্ভরতা কমিয়ে তাদের
স্বনির্ভর ও স্বাবলম্বী করে তুলতে। হিন্দু মেলার প্রথম সচিব গণেন্দ্রনাথ
ঠাকুর ভারতবাসীর
পরনির্ভরতা মনুষ্যত্বের পক্ষে লজ্জাজনক বলে উল্লেখ করে আত্মনির্ভরতার চেতনাকে
মেলার আদর্শের অঙ্গীভূত করার কথা বলেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, ইংরেজি
আচার-আচরণের অনুকরণ কেবল ভারতের সঙ্গে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের যোগসূত্রটিকে দৃঢ়তা
দান করবে। যা ভারতের সাংস্কৃতিক সংহতির পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে। এই জন্য তিনি
আধুনিকতাবাদীদের পাশ্চাত্য অভিজ্ঞতার আলোকে ভারতীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে যথাযথভাবে
অবহিত হতে এবং সমাজের ভিতর থেকে তার পরিবর্তন সাধন শিক্ষা করার আহ্বান জানান। ১৮৬৭ সালের এপ্রিল মাসে
হিন্দু মেলা আয়োজনের সময় সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতায় ছিলেন না। তবে ১৮৬৮ সালের দ্বিতীয় হিন্দু মেলায় তিনি
উপস্থিত ছিলেন। এই উপলক্ষে তিনি ‘মিলে সবে ভারতসন্তান’ গানটি রচনা করেন। এই গানটি ভারতের প্রথম জাতীয়
সঙ্গীতের মর্যাদা অর্জন করে। এই সভায় কিশোর রবীন্দ্রনাথ সাধারণের সামনে গাছের নীচে
দাঁড়িয়ে ‘হিন্দুমেলার উপহার’ স্বরচিত কবিতা আবৃতি করেন।
১৮৭০ সাল থেকে এপ্রিলের
বদলে ফেব্রুয়ারি মাসের মেলার আয়োজন করা হতে থাকে। এই সময় মেলার নামকরণ হয়
জাতীয় মেলা। মেলায় নবকুমার মিত্রের প্রভাব ১৮৭৫ সাল অবধি বজায় ছিল। তারপর তিনি
মেলার আয়োজন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। ১৯৮০-এর দশকে হিন্দু মেলা ম্লান হয়ে যায়।
প্রশ্ন: হিন্দু মেলায়
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অংশগ্রহণ সম্বন্ধে যা জানো আলোচনা করো।
উত্তরঃ
১৮৬৭
সালের এপ্রিল মাসে ঠাকুর পরিবারের সহযোগীতায় কলকাতায় প্রথম হিন্দু মেলা আয়োজিত
হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ
তখন বালক মাত্র কিন্তু কয়েক বছর পরেই তিনি এই মেলার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। ১৮৭৫ সালে
রাজনারায়ণ বসুর সভাপতিত্বে আয়োজিত হিন্দু মেলায় তিনি একটি স্বরচিত কবিতা পাঠ
করেন। ১৩-১৪ বছর বয়সী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বদেশ চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ইংরেজের দেশ শাসনের বিরুদ্ধে
লেখনী ধারণ করেছিলেন। কখনো কখনো ১৪ই ফেব্রুয়ারি ১৮৭৭ সালে অনুষ্ঠিত হয় এই
অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপস্থিত হন এবং একটি গান ও দিল্লির দরবার গদ্য অবলম্বনে
একটি কবিতা রচনা করেছিলেন কিন্তু সেখানে তা পরিবেশন করা সম্ভব হয়নি। ফলে মেলা
প্রাঙ্গণে ‘হিন্দু মেলার উপহার’ কবিতা আবৃত্তি করেন এবং গান গেয়ে শোনান।
প্রশ্নঃ ভারতের সর্বজনীন পরিচ্ছদ হিসেবে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর কি ধরনের
পোশাক তৈরি করেছিলেন?
উত্তরঃ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর হলেন রবীন্দ্রনাথের জ্যোতিদাদা। অসাধারণ
প্রতিভার অধিকারী জ্যোতিদাদা সাহিত্য চর্চা এবং সঙ্গীতে পারদর্শী ছিলেন। স্বদেশ প্রেমে
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর বিদেশি পোশাক পছন্দ করতেন না। স্বদেশীয় একটা পোশাক
তৈরি করার উদ্দেশ্যে নানা প্রকারের নমুনা উপস্থিত করতেন। কারণ ধুতি
বাঙালির জাতীয় পোশাক হলেও কর্ম ক্ষেত্রে উপযোগী নয় কিন্তু পায়জামা কাজে উপযোগি
হলেও পায়জামাটা বাঙালির জাতীয় পোশাক নয়, এটি বিজাতীয়। তাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ উভয়কে একত্র করে একটি কৃত্রিম পোশাক
তৈরি করলেন। তিনি পায়জামার
উপর একখন্ড কাপড় পাট
করে একটা স্বতন্ত্র কৃত্রিম মালকোঁচা জুড়ে দিলেন। সোলার টুপির
সঙ্গে পাগড়ি মিশিয়ে এক আদ্ভুত পোশাক তৈরি করলেন। যা অত্যন্ত
উৎসাহী লোকও
শিরোভূষণ
করতে কুন্ঠাবোধ করতেন। কিন্তু জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এই সার্বজনীন পোশাক পরে সর্বসম্মুখে গাড়িতে করে কলকাতার রাস্তায় ঘুরে বেড়ান।
প্রশ্নঃ স্বাদেশিক সভার দলবলের শিকার পর্বের বর্ণনা দাও।
উত্তরঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘স্বাদেশিকতা’ গদ্যাংশ অনুসারে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ
ঠাকুর প্রতি রবিবার দলবল নিয়ে শিকারে বের হত। একাধিক অপরিচিত জনসাধারণ তাদের
মধ্যে এসে জুটত।
তাদের
মধ্যে ছুতার, কামার প্রভৃতি সকল শ্রেণির লোকই ছিল। কারণ শিকার উদ্দেশ্য হলেও
রক্তপাত তেমনটা করা হতনা। শিকারের বাইরে আর সব অনুষ্ঠান ভরপুর মাত্রায় ছিল। বউ
ঠাকুরানীর হাতের তৈরি রাশিকৃত লুচি তরকারি নিয়ে প্রাতঃকালে তারা বের হইয়নি। এটাকে
শিকার করতে হতনা বলে একদিনও তাদের উপবাস থাকতে হয়নি।
আর মানিকতলার যেকোনো একটি বাগানে ঢুকে পরতেন। সেখানকার
একটা পুকুরের বাধানো ঘাটে বসে উচ্চ নিচ নির্বিচারে সকলে মিলে একসঙ্গে সেই লুচি
তরকারি খেয়ে পাত্রটাকে বাকি রাখতেন।
প্রশ্নঃ শিকার থেকে ফেরার পথে এক বাগানে ঢুকে ব্রজবাবু কি করেছিলেন?
উত্তরঃ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত স্বাদেশিক সভার উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক
শিকার পর্বের সদস্য হলেন ব্রজবাবু অর্থাৎ ব্রজনাথ দে। তিনি মেট্রোপলিটন কলেজের
সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন। কিছুদিন লেখকের গৃহ শিক্ষক ছিলেন। একদিন শিকার
থেকে ফেরার পথে তিনি মানিকতলার একটি বাগানে ঢুকে মালিককে জিজ্ঞাসা করেন যে, মামা
ইতিমধ্যে এসেছিল কিনা? মালী তাকে প্রণাম করে জানায় যে, মামা আসেনি। এরপর ব্রজবাবু
মালীকে ডাব পাড়িয়ে আনতে
বলে। সেদিন সকলে মিলে ডাবের জল পান করেন অর্থাৎ মামার উপস্থিতির খবরটি ছিল তার অছিলা মাত্র।
ডাবের জল খাওয়াই ছিল মূল উদ্দেশ্য। তার তত্ত্বাবধানে বউ ঠাকুরানীর লুচির সঙ্গে পানীয়ের অভাব
হয় নি।
প্রশ্নঃ রবীন্দ্রনাথদের স্বাদেশিক সভার কার্যাবলীর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও।
উত্তরঃ রবীন্দ্রনাথের জ্যোতিদাদা ওরফে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের উৎসাহে
দেশবাসীর মধ্যে স্বাদেশিকতা জাগানোর জন্য স্বাদেশিক সভা আয়োজিত হত। সেই সভার সভাপতি
হলেন বৃদ্ধ রাজনারায়ণ বসু। তিনি একজন প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব ও লেখক ছিলেন। কলকাতার গলির
মধ্যে এক পোড়ো বাড়িতে সেই সভা বসত। এই সভার সমস্ত কার্যাবলী রহস্যে আবৃত থাকত। যদিও তাতে রাজা
প্রজার ভয়ের কিছু ছিল না। সভার সদস্যদের আত্মীয়রাও জানতেন না যে তারা কোথায় যাচ্ছেন
কী করছেন? সভা যখন বসতো তখন দ্বার রুদ্ধ থাকতো, ঘর অন্ধকার
থাকতো। সভ্যদের দীক্ষা
হত ঋক মন্ত্রে। আলোচনা হত চুপি
চুপি। প্রাচীন-অর্বাচীন
সকলেই স্বাদেশিকতা সভার সভ্য হতে পারতেন। সবাই যেন স্বদেশ
প্রেমের উৎসাহে ঘুরে বেড়াতেন। লজ্জা ভয় সংকোচ কিছুই তাদের ছিল না। সভা করে, কল্পনা
করে, বাক্যালাপ করে, গান গেয়ে তারা
তাদের উন্মাদনা জাহির করতেন।
সভার মুল উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় কল্যান ও উন্নতিকর সমস্ত
কার্যাবলী। তাই জ্যোতিদাদা ভারতবর্ষের একটি সার্বজনীন পরিচ্ছদ বানানোর নমুনা
তৈরি করেন এবং অবলীলায় সেই অদ্ভূদ পোশাক পরে ঘুরে বেড়াতেন। আসলে স্বাদেশিক সভার
মাধ্যমে স্বদেশীয় দিয়াশলাই, স্বদেশীয় কাপড়ের কারখানা স্থাপন করাই
তাদের উদ্দেশ্য ছিল।
প্রশ্নঃ স্বাদেশিকতা পর্বে রাজনারায়ণ
বসু সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের পর্যালোচনার একটি আলোচনা করো।
উত্তরঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘স্বাদেশিকতা’ গদ্যাংশে
লেখক রাজনারায়ণ বসু সম্বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ পর্যালোচনা করেছেন। জানা যায় যে
লেখক এর ছেলেবেলায় স্বাদেশিকতা পর্বে যখন রাজনারায়ণ বসুর সঙ্গে প্রথম তাদের
পরিচয় হয় তখন সব দিক থেকে রাজনারায়ণ বসুকে পরিমাপ করার ক্ষমতা তাদের ছিল না। কারণ তার
চরিত্র ও কার্যাবলীর মধ্যে একাধিক বৈপরীত্যের সমাবেশ ঘটেছিল।
তিনি স্বদেশপ্রেমী, বিদ্বান ও সাহিত্যিক। বৃদ্ধ হলেও স্বাদেশিক
সভার সভাপতি ছিলেন এবং স্বাদেশিকতার দলের সব থেকে কনিষ্ঠ সদস্যের সঙ্গেও তার সমান
আবেগ মিশ্রিত সংযোগ ছিল। তাঁর বাহ্যিক প্রবীণতা অন্তরের নবীনতাকে কখনোই গ্রাস করতে
পারেনি। স্বভাবের দিক
থেকে তিনি ছিলেন অতি সহজ মানুষ। জীবন পথের কোনরকম দুঃখ কষ্ট, অস্বাস্থ্য কোন কিছুই তার
জীবন থেকে আনন্দকে দূরে রাখতে পারেনি। নিজের জীবন ও
সংসারকে ঈশ্বরের হাতে সমর্পণ করে তিনি সর্বদাই নিয়োজিত ছিলেন দেশের উন্নতি সাধনে। রিচার্ডসনের
প্রিয় ছাত্র হওয়ার সুবাদে ইংরেজি শিক্ষাতে বাল্যকাল থেকে শিক্ষিত হয়েও
রাজনারায়ণ বসু সমস্ত বাধা অতিক্রম করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অঙ্গনে প্রবেশ করেন। স্বদেশপ্রীতি
তার মধ্যে এত প্রভূত পরিমাণে ছিল যে দেশের কোনোরকম হীনতা তিনি সহ্য করতে পারতেন না। নিজের তেজ দীপ্তিতে
তা দগ্ধ করতে চাইতেন। কণ্ঠে সুর না থাকলেও মনের আবেগে তিনি স্বদেশী সংগীত গাইতেন। কঠোরে-কোমলে
রাজনারায়ণ বসু ছিলেন এক আদর্শ চরিত্র।
প্রশ্নঃ ‘‘দ্বার আমাদের রুদ্ধ, ঘর আমাদের অন্ধকার, দিক্ষা আমাদের ঋক মন্ত্রে, কথা আমাদের চুপি চুপি- ইহাতেই সকলের রোমহর্ষণ হইতো, আর বেশি কিছু প্রয়োজন
ছিল না”। ব্যাখ্যা কর
উত্তরঃ আলোচ্য অংশটি রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থের
অন্তর্ভুক্ত ‘স্বাদেশিকতা’ পাঠ থেকে
গৃহীত। ঠাকুরবাড়ির
স্বাদেশিকতা সভা প্রসঙ্গে এই উক্তিটি করা হয়েছে।
পরাধীন ভারতবর্ষে স্বদেশীয়ানার কাজ লুকিয়ে লুকিয়ে
করা হতো।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে কলকাতার কোন এক গলির পোড়ো বাড়িতে স্বাদেশিকতার সভা
বসত। সেই সভার সমস্ত
অনুষ্ঠান রহস্যে ঘেরা ছিল। কে কোথায় কি কাজ করতো তা কখনো প্রকাশ পেত না। অন্ধকার ঘরে
সদস্যরা চুপি চুপি সভার কার্যকলাপ নিয়ে আলাপ আলোচনা করতেন। তাঁরা ছিলেন সবাই
ঋক মন্ত্রে দীক্ষিত। বৃদ্ধ থেকে অল্প বয়সে যে কেউই এই সভার সদস্য হতে পারতেন।
সভার মুল উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় কল্যান ও উন্নতিকর সমস্ত
কার্যাবলী। স্বাদেশিক সভার মাধ্যমে স্বদেশীয় দিয়াশলাই, স্বদেশীয়
কাপড়ের কারখানা স্থাপন করাই তাদের মুল উদ্দেশ্য ছিল। পরাধিন ভারত বর্ষে
স্বদেশীয় কার্যকলাপ করার জন্যই দ্বার বন্ধ করে চুপি চুপি সভার কাজ করত।
প্রশ্নঃ গঙ্গার ধারে এক বাগানে ঝড়ের সময় স্বাদেশিক সভার সদস্যদের আচরণ ও
রবীন্দ্রনাথের অভিজ্ঞতা বর্ণনা কর।
উত্তরঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘স্বাদেশিকতা’ প্রবন্ধ থেকে
জানা যায় যে প্রতি রবিবার লেখকদের স্বাদেশিক সভার সভ্যদের সঙ্গে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ
ঠাকুর শিকারে যান। তাদের দলের মধ্যে একজন নিষ্ঠাবান হিন্দু মধ্যবিত্ত জমিদার
ছিলেন। গঙ্গার ধারে
তার একটি বাগান ছিল। কোন একদিন শিকার থেকে ফেরার পথে তারা সকলেই সেই বাগানে
গিয়ে জাতি বর্ণ নির্বিশেষে সকলে মিলে আহার করেন। আহারের পর অপরাহ্ণে
প্রবল ঝড় উঠলে স্বাদেশিক সভার সকল সভ্যরা গঙ্গার ঘাটে দাড়িয়ে এক্সঙ্গে চিৎকার করে
গান করতে থাকেন। তাদের দলের মধ্যে সেদিন বৃদ্ধ রাজনারায়ণ বসু উপস্থিত
ছিলেন। রাজনারায়ণ বসুর
কণ্ঠে সুরের চলন স্বচ্ছন্দ ছিল না। এমনকি তার কণ্ঠস্বরের শক্তিও খুব বেশি ছিল না। কিন্তু তিনি
গানের বিষয়বস্তুর মধ্যে আত্মলীন হয়ে যেভাবে গানটাকে অনুভব করে গাইতেন তা এক
উপভোগ্য বিষয় হয়ে উঠত। সুত্রের চেয়ে ভাষয অনেক বেশি তেমনি তাঁর গানের চেয়ে হাত ও মাথা
নাড়ার পরিমান অনেক বেশি ছিল। আর ঝড়ের হাওয়া যেন তাঁর পাকা দাড়িতে মাতামাতি করতে লাগল। ঝড় থেমে গেলে
অনেক রাতে গাড়ি করে তারা বাড়ি ফিরল। অন্ধকার নির্জন-নিস্তব্ধ পথ দিয়ে তাদের গাড়ি ফিরছিল তখন
পথের দু’ধারে বনশ্রেণীর
মধ্যে কেবলমাত্র দলে দলে জোনাকি আলো ছড়াতে থাকে।
No comments