Header Ads

কল্পবিজ্ঞান উৎপত্তি ও বিকাশ

 কল্পবিজ্ঞান উৎপত্তি ও বিকাশ

সংজ্ঞাঃ

কল্পবিজ্ঞান শব্দটির দুটি অংশ। প্রথমটি হচ্ছে ‘কল্প’, যার অর্থ কল্পনা অর্থাৎ যেখানে বাস্তব ও বাস্তবের মিশ্রণ থাকে এমন ভাব আর বিজ্ঞান কথাটির অর্থ হল জ্ঞান বা যুক্তি। যুক্তি বা বুদ্ধির সাহায্যে সত্যসন্ধান সেদিক থেকে ‘কল্পবিজ্ঞান শব্দটির অর্থ হিসেবে বলা যায় বাস্তব অবাস্তবে মেশানো বা কল্পনার মাধ্যমে সত্যসন্ধান ইংরেজিতে একেই বলে সায়েন্স ফিকসান’। এখানে সায়েন্স কথাটির অর্থ হল সত্যসন্ধান। ফিকসান শব্দটির অর্থ আসলে বাস্তব জগতের যা সব সময় ঘটে না, তা কল্পনার মাধ্যমে তাকে তৈরি করার শিল্পিত প্রচেষ্টা সায়েন্স ফিকসান বা কল্পবিজ্ঞানের আভিধানিক অর্থ আসলে সত্য সন্ধান বা বিজ্ঞানভিত্তিক বানানো বা কাল্পনিক গল্প বা অলীক কাহিনী

উইলিয়াম উইলসন ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে তার ‘লিটিল আর্নেস্ট বুক আপন এ গ্রেট ওউন সাবজেক্ট’  যার প্রকাশক ছিলেন ডাল্টন এন্ড কোম্পানি (ইউকে) এই গ্রন্থে প্রথম কল্পবিজ্ঞান শব্দটির প্রয়োগ করেন। যদিও এক্ষেত্রে মতবিরোধ আছে। কুন্তল চট্টোপাধ্যায় সাহিত্যের রূপরীতি গ্রন্থে বলেছিলেন যে উইলসনের আগে অর্থাৎ ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে অ্যামেজিং স্টোরিজ পত্রিকার সম্পাদক হুগো গার্নেস্ ব্যাক তিনি প্রথম সায়েন্স ফিকশন কথাটি ব্যবহার করেছিলেন যাই হোক না কেন সাইন্স-ফিকশন বলে যে শব্দবন্ধটি আমরা ব্যবহার করছি ইংরেজিতে তাকেই আমরা বাংলায় বলেছি কল্পবিজ্ঞান’। খানিকটা বিজ্ঞানের চর্চা, কল্পনার মাধ্যমে অর্থাৎ অবাস্তব, যা এখনো ঘটেনি, ঘটতে পারে বা সম্ভাব্য এমন বিজ্ঞান বিষয়ক রচনাকে এক কথায় কল্পবিজ্ঞান বলি।

কল্পবিজ্ঞান সম্পর্কে নানান জন নানান রকমের সংজ্ঞা দিয়েছেন

J. O. Bailey. 1947. "A piece of scientific fiction is a narrative of an imaginary invention or discovery in the natural sciences and consequent adventures and experiences... It must be a scientific discovery—something that the author at least rationalizes as possible to science.

Theodore Sturgeon. 1952. "A science fiction story is a story built around human beings, with a human problem, and a human solution, which would not have happened at all without its scientific content."

Rod Serling. 1962. "Fantasy is the impossible made probable. Science Fiction is the improbable made possible."

 


উদ্ভব ও বিকাশঃ

প্রাচীন কাল থেকেই কল্পবিজ্ঞানের সূচনা হয়েছিল, বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনীর মাধ্যমে তাঁর সম্ভাব্যতা দেখানো হয়েছে। ব্যঙ্গাত্মক লুসিয়ার দ্বারা খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে রচিত, একটি কাহিনিকে প্রথম কল্পকাহিনী হিসাবে বিবেচনা করেন। দশম শতাব্দীর The Tale of the Bamboo Cutte ত্রয়োদশ শতাব্দীর থিওলজাস অটোডিড্যাকটাসে কল্পবিজ্ঞানের উপাদান ছে ।

জোহানেস কেপলারের ‘সোমনিয়াম (১৬৩৪), ফ্রান্সিস বেকনের ‘নিউ আটলান্টিস (১৬২৭), অ্যাথানাসিয়াস কিরচের ইটিনেরেরিয়াম এক্সট্যাটিকাম (১৬৫৬), সিরানো ডি বার্গেরাকের Comical History of the States and Empires of the Moon (1657) এবং The States and Empires of the Sun (1662), মার্গারেট ক্যাভেনডিশের "দ্য ব্লজিং ওয়ার্ল্ড" (১৬৬৬), জোনাথন সুইফটের Gulliver's Travels (1726), লুডভিগ হলবার্গের নিকোলাই ক্লিমি ইটার সাবটারেনিয়াম (1741) এবং ভোল্টায়ারের মাইক্রোম্যাগাস (১৭৫২) রচনাগুলিকে প্রথমসারির কল্পবিজ্ঞান হিসাবে গণ্য করা হয়।

আরো বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন এই ভিডিওতে - 



সপ্তদশ শতকে মেরি শেলির ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন (1818) এবং দ্য লাস্ট ম্যান (1826) রচনায় কল্পবিজ্ঞান সার্থকতা লাভ করে। ব্রায়ান আল্ডিসের মতে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনই ছিল কল্পবিজ্ঞানের প্রথম রচনা। এডগার অ্যালান পো বেশ কয়েকটি গল্প লিখেছিলেন যা বিজ্ঞানের কল্পকাহিনী হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল, যার মধ্যে রয়েছে "দ্য আনপ্যারালাল্ড অ্যাডভেঞ্চার অফ ওয়ান হ্যান্স পাফাল" (1835)  সেখানে চাঁদ ভ্রমণের বর্ণনা ছিল।  জুলে ভার্ন এর ‘টুইনটি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার থ্যা সী’ (১৮৭০) রচনায় বৈজ্ঞানিক নির্ভুলতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জুলে ভার্নকে পাশ্চাত্য কল্পবিজ্ঞানের জনক বলা হয়। ১৮৮৭ সালে, স্প্যানিশ লেখক এনরিক গ্যাস্পার ওয়াই রিম্বা-র উপন্যাস টাইম মেসিন সম্পর্কে প্রথমবারের মতো পরিচয় করায়। অনেক সমালোচক এইচ জি ওয়েলসকে কল্পবিজ্ঞানের অন্যতম লেখক বলেছেন। এছাড়াও এডগার রাইস, জন ডব্লু, থিওডোর স্টারজন, অ্যান ম্যাকক্যাফ্রি, উরসুলা কে লে গুইন, লিউ সিক্সিন প্রমুখরা কল্পবিজ্ঞান চর্চায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে।

বাংলা কথাসাহিত্যে এই ফর্মটি নতুন। এটি এক ধরনের গদ্য রচনা এতে মানবজাতির সম্ভাব্য প্রযুক্তিনির্ভর কাহিনি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়।

ল্পবিজ্ঞানধর্মী রচনা সাধারণত দুধরনের বিষয় বা কাহিনী থাকে। একটিতে থাকে প্রতিষ্ঠানিক বিজ্ঞান তথ্যের উপরে কাল্পনিক বা রঙ্গিন জাতীয় গল্প। কল্পনার মাধ্যমে আপাত অবাস্তব মনে হলেও ভবিষ্যতের বাস্তবে তা বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প।

বাংলা সাহিত্যে কল্পবিজ্ঞানের পরিচয় তেমনভাবে পাওয়া যায় না। যদিও ‘রামায়ণ মহাভারত এবং ভাগবত’ প্রভৃতি মহাকাব্যে কল্পবিজ্ঞানের অল্পবিস্তর প্রকাশ দেখা যায়। যেমন রামায়ণে মেঘনাদের পুষ্পরথ আধুনিক বিমান কিংবা রাবনের শক্তিশেল আধুনিক মিশাইলের প্রতিরূপ।  এছাড়াও মেঘনাদের মেঘের আড়াল থেকে যুদ্ধ করা ইনভিজিবল ম্যানের কাল্পনিক তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করে যেটা ফরাসি লেখকেগ্রন্থেও পরিচয় পাই। এছাড়াও মহাভারত, ভাগবতেও এই ধরণের কল্পবিজ্ঞানের সন্ধান পাওয়া যায়।

যদিও প্রথাগতভাবে বঙ্কিমচন্দ্রের লোকরহস্য গ্রন্থের সুবর্ণ গোলক’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ইচ্ছাপূরণ’, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বুড়া আংলা’ প্রভৃতি রচনায় কল্পবিজ্ঞানের ছোওয়া আছে।

১৮৮২ সালে প্রথম বাংলা কল্পবিজ্ঞান ভিত্তিক রচনা লেখেন হেমলাল দত্ত। তাঁর রহস্য গল্পটি প্রকাশিত হয় ‘সচিত্র বিজ্ঞান দর্পন’ পত্রিকায়। সমালোচক সিদ্ধার্থ ঘোষ তাঁর লেখাটিকে কল্পবিজ্ঞানের প্রথম লেখা বলে অভিহিত করেন। তবে এ নিয়ে মত বিরোধ আছে।

বাংলা সাহিত্যে আক্ষরিক অর্থে বিশুদ্ধ বিজ্ঞান ভিত্তিক গল্প লেখেন জগদিশ্চন্দ্র বসু ১৮৯৬ সালে। অনেকের মতেই বিজ্ঞানী জগদিশ্চন্দ্র বসু বাংলা সাহিত্যে কল্পবিজ্ঞানের জনক ও সার্থক শিল্পী । জগদীশচন্দ্র বসু প্রথম রচনা করেন নিরুদ্দেশের কাহিনী পরে ‘অব্যক্ত’ গ্রন্থে ‘পলাতক তুফান’ নামে প্রকাশিত হয় । এছাড়াও জগদানন্দের ‘শুক্র ভ্রমন’ প্রাকৃতিকি গ্রন্থে প্রকাশিত হয়। এই বিজ্ঞান কল্পকাহিনীমূলক গ্রন্থ রচনার জন্যই তাকে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান কল্পকাহিনীমূলক সাহিত্য চর্চার অগ্রদূত হিসেবে আখ্যায়িত করা য়। এদের হাত ধরেই বাংলা সাহিত্যে কল্পবিজ্ঞানের লেখালেখি শুরু হয়।

তবে বাংলা সাহিত্যে স্বতন্ত্রভাবে কল্পকাহিনীমূলক লেখালেখি শুরু করলেন সুকুমার রায় (১৮৮৭ - ১৯২৩)। স্যার আর্থার কুনান ডায়ালের দ্বারা অনুপ্রানিত হয়ে তিনি লেখেন  হেশোরাম হুশিয়ারের ডায়েরি’। আরেকজন প্রতিষ্ঠিত লেখক হলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র (১৯০৪ – ১৯৮৮)। তাঁর রচনাগুলি হল  "কালাপানির অতলে", "দুঃস্বপ্নের দ্বীপ", "যুদ্ধ কেন থামল", "মানুষের প্রতিদ্বন্দ্বী", "হিমালয়ের চূড়ায়", "আকাশের আতঙ্ক", "অবিশ্বাস্য", "লাইট হাউসে", "পৃথিবীর শত্রু", "মহাকাশের অতিথি", "শমনের রং সাদা",  পিঁপড়ে পুরাণ, পাতালে পাঁচ বছর, ময়দানবের দ্বীপ, শুক্রে যারা গিয়েছিল, মনুদ্বাদশ, সূর্য যেখানে নীল, ঘনাদা সিরিজ ইত্যাদি

হেমেন্দ্র কুমার রায়, ক্ষিতিন্দ্র নারায়ণ ভট্টাচার্য, উল্লেখযোগ্য। তবে বাংলা  কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যে শক্তিশালী গল্প নিয়ে আসেন সত্যজিৎ রায়। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাগুলি হল - প্রফেসর শঙ্কু, প্রোফেসর শঙ্কুর কাণ্ডকারখানা, শঙ্কু একাই ১০০, সেলাম প্রোফেসর শঙ্কু, ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি (১৯৬৫-৬৬), শেয়াল-দেবতা রহস্য (১৯৭০), ভূস্বর্গ ভয়ংকর (১৯৮৭), লন্ডনে ফেলুদা (১৯৮৯), ইন্দ্রজাল রহস্য (১৯৯৫-৯৬), কেরোডেক্টিলের ডিম ইত্যাদি।

অদ্রীশ বর্ধন, সমরজিৎ কর, সংকরশন রায়, জয়ন্ত বিষ্ণু, নারলিকার, রাজশেখর বসু (পরশুরাম), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের (নীললোহিত), নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, লীলা মজুমদার, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, ইনাক্ষী চট্টোপাধ্যায় কল্পবিজ্ঞান নিয়ে লিখেছেন এদের চেষ্টায় বাংলা সাহিত্যে কল্পবিজ্ঞান একটি নতুন মাত্রা পায়।

অধুনা বাংলাদেশের কল্পবিজ্ঞান নিয়ে লিখছেন দীপেন ভট্টাচার্য, মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও আরো অনেকে। তবে এ দেশের মতো আকর্ষনীয় গল্প তেমনটা লেখা হয়নি।

পত্রপত্রিকার দিক থেকে ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত আশ্চর্য’, ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘ফ্যান্টাস্টিক’, এবং ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘কিশোর জ্ঞানবিজ্ঞান’ ছিল কল্পবিজ্ঞানের আকর খনি।  

*********************prge4**************************

No comments

Powered by Blogger.