বাংলা ভাষা ও তার উপভাষা সমূহ
ভাষাঃ
ভাষা
হল মানুষের কণ্ঠোচ্চারিত অর্থবহ ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টি।
ভাষার আভিধানিক অর্থ
হল – অর্থযুক্ত কথন, উক্তি, মনোভাব জ্ঞাপক সংকেতাদি।
ভাষা হল মানুষের
মনের ভাব আদানপ্রদানের প্রধান মাধ্যম।
ভাষা মানুষের মনের
ভাবকে সম্পূর্ণ প্রকাশ করে।
মনের চিন্তাভাবনা
বা ভাব পরস্পরের মধ্যে বিনিময় করার জন্য মুখে উচ্চারিত ধ্বনি বা ধ্বনিপ্রবাহ হল ভাষা।
ধ্বনি বা শব্দই ভাষার
মূল সম্পদ।
শ্রীসুকুমার সেনের
মতে, ‘মানুষের উচ্চারিত, অর্থবহ, বহুজনবোধ্য ধ্বনিসমষ্টিই ভাষা’।
ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের
মতে, ‘মনের ভাব প্রকাশের জন্য বাগ্যন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনির দ্বারা নিষ্পন্ন,
কোনও বিশেষ জনসমাজে ব্যাবহৃত, স্বতন্ত্রভাবে অবস্থিত, তথা বাক্যে
প্রযুক্ত শব্দসমষ্টিকে ভাষা বলে’।
ভাষা একটি সামাজিক
বিষয়, যা বহুজনবোধ্য।
সমাজের
পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের জন্য যার সাহায্যে নিজের মনের
ভাব প্রকাশ করে সাধারণভাবে তাকে বলা হয় ভাষা।
প্রশ্নঃ ভাষাবিজ্ঞানী
স্টার্টেভাণ্টের মতে ভাষা হল মানুষের বাগ্যন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত কতগুলি –
ক) ধ্বনির সমষ্টি
খ) ধ্বনিগত প্রতীকের
সমষ্টি
গ) ধ্বনিগত নিয়মাবলী
ঘ) যেকোনো নিয়মের
সমষ্টি
ভাষা কোন ভঙ্গিগত একক
নয়।
একমাত্র ধ্বনিগত প্রতীকীই ভাষা।
ভাষা বাগ্যন্ত্রের
সাহায্যে উচ্চারিত হয়।
স্টার্টেভাণ্টের
মতে, “A language is a system of arbitrary vocal symbols by which members of a
social group co-operative and interact.”
অর্থাৎ ভাষা হল
কতগুলি অর্থবোধক ধ্বনি সমষ্টির বিধিবদ্ধ রূপ। যার
সাহায্যে একটি বিশেষ সমাজের লোকেরা নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময় করে।
ভাষা হল মানুষের বাগ্যন্ত্রের
সাহায্যে উচ্চারিত কতগুলি ধ্বনিগত প্রতীকের সমষ্টি।
ভাষার ধ্বনিগুলি হল অর্থের প্রতীক।
ধ্বনি বা শব্দ বিন্যাসের
বিধিবদ্ধতা ভাষার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
বিশেষ বিশেষ ভাষা বিশেষ
বিশেষ সমাজের প্রয়োজন সিদ্ধ করে।
াঙালির জনসমাজে মানুষের বাগ্যন্ত্রের
সাহায্যে উচ্চারিত যে সমস্ত অর্থবহ বিধিবদ্ধ ধ্বনির
সাহায্যে ভাব বিনিময় করা হয়, তাদের
সমষ্টিকে বাংলা ভাষা বলা হয়।
ভাষা যে কোনো জাতির
আত্মপরিচয়ের প্রতীক বা চিহ্ন। আর বাংলা ভাষাও বাঙালির আত্মপরিচয়।
উপভাষা
প্রশ্নঃ একই ভাষার মধ্যে
আঞ্চলিক পৃথক রূপ হল –
ক) উপভাষা
খ) অপভাষা
গ) সংকেত ভাষা
ঘ) শিষ্ট ভাষা
উপভাষা ভাষার সদৃশ
বা মতো।
একই ভাষার মধ্যে আঞ্চলিক পৃথক
রূপকে উপভাষা বলে।
মূল ভাষার অনুসারী
এবং সাদৃশ্যপূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন ভাষাগোষ্ঠির ভাষাকে উপভাষা বলে।
সুকুমার সেনের মতে,
কোনো ভাষা-সম্প্রদায়ের অর্ন্তগত ছোটো ছোটো দলে বা অঞ্চলবিশেষে প্রচলিত ভাষা-ছাঁদকে উপভাষা বলে।
দেবাশিষ মৌলিকের
মতে, ‘নির্দিষ্ট ভৌগলিক অঞ্চলের সীমিত সংখ্যক জনগণ নিজেরদের জীবনযাত্রার দৈনন্দিন প্রয়োজনে
এবং পারস্পরিক ভাববিনিময়ের তাগিদে যে আটপৌরে সহজ বোধগম্য ভাষা ব্যবহার করে তাকে উপভাষা
বা আঞ্চলিক ভাষা বলে।
ভাষার ব্যবহারিক
রূপ হল উপভাষা।
উপভাষা দৈনন্দিন
জীবনযাপনের ভাষা।
উপভাষা হল আদর্শ
একটি ভাষার একটি ভাষার আঞ্চলিক রূপ।
আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য
এবং উচ্চারণ রীতি উপভাষাকে ভাষা থেকে পৃথক
করেছে।
উপভাষা হল আঞ্চলিক
জনসাধারণের মুখের ভাষা।
তবে লেখালেখির সময়
আদর্শ ভাষা ব্যাবহৃত হয়।
উপভাষার শব্দাবলীগুলির
নৃতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক ও সামাজিক গবেষণায় গুরুত্ব আছে।
উপভাষায় লেখা গানগুলি
লোকসঙ্গীত বা লোকগীতি হিসেবে পরিচিত।
দুটি জনগোষ্ঠী যখন সংস্কৃতি
সংস্কৃতির দিক থেকে পৃথক হয় তখন তাদের আঞ্চলিক ভাষা স্বতন্ত্র ভাষার মর্যাদা পায়।
উপভাষাকে ভাষার
ব্যবহারিক রূপ বলা যায়।
বাংলা উপভাষা পাঁচটি।
এদের মধ্যে মান্য উপভাষা হল রাঢ়ী।
ভাষা ও উপভাষার পার্থক্য
ভাষা ও উপভাষার পার্থক্য চূড়ান্ত
নয়, আপেক্ষিক; শ্রেণীগত নয়, মাত্রাগত।
ভাষা একটি বৃহৎ অঞ্চলে
প্রচলিত, উপভাষা অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র অঞ্চলে
প্রচলিত।
ভাষার একটি সর্বজনীন আদর্শরূপ থাকে।
উপভাষায় সাধারনত লোকসাহিত্য
রচিত হয়।
বাংলা ভাষা ও তার
উপভাষাঃ
ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যঃ
রাঢ়ী |
বরেন্দ্রী |
বঙ্গালী |
ঝাড়খণ্ডী |
কামরূপী |
ই, উ, ক্ষ এবং য- ফলা
যুক্ত ব্যঞ্জনের পূর্বগামী ‘অ’ এর উচ্চারণ ‘ও’ হয়। যেমন – অতি > ওতি, সত্য
> শোত্তো |
ই, উ, ক্ষ এবং য- ফলা যুক্ত ব্যঞ্জনের পূর্বগামী ‘অ’ এর
উচ্চারণ ‘ও’ হয়। যেমন – অতি > ওতি, সত্য > শোত্তো |
শব্দমধ্যে অবস্থিত ই,
উ তার পূর্ব্বর্তী ব্যঞ্জনের পূর্বে সরে আসে। যেমন – আজি > আইজ |
|
|
|
|
|
ও কারের অ কার উচ্চারণের ব্যপক প্রভাব দেখা যায়। বকা>বোকা,
দকান>দোকান। |
আদিতে অ > আ এবং আ>অ
হয়ে যায়। যেমন – কথা>কাথা, মহাজন>মাহাজন, খাসি>খসি। |
অভিশ্রুতির প্রভাব। স্বরসঙ্গতি দেখা যায়।
যেমন – দেশি>দিশি |
অভিশ্রুতির প্রভাব। |
অপিনিহিতির প্রভাব। |
অপিনিহিতির প্রভাব। কখনও কখনও বিপর্যাস। |
|
নাসিক্যধ্বনির লোপ এবং
ওই ব্যঞ্জনের পূর্ববর্তী অনুনাসিক হয়। যেমন – চন্দ্র>চাঁদ |
নাসিক্যধ্বনির লোপ এবং ওই ব্যঞ্জনের পূর্ববর্তী অনুনাসিক
হয়। যেমন – চন্দ্র>চাঁদ |
নাসিক্যধ্বনির লোপ পায়
না এবং অনুনাসিক হয় না। যেমন – চন্দ্র>চান্দ |
অনুনাসিকতা এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। চাঁ (চা) |
|
|
|
এ অ্যা রূপে উচ্চারিত
হয়। দেশ>দ্যাশ, শেষ>শ্যাষ। |
|
ও কখনও কখনও উ রূপে উচ্চারিত
হয়। যেমন – সোনালী>সুনালী, তোমার>তুমার। |
শব্দের অন্তে অঘোষ সঘোষ
কিংবা সঘোষ অঘোষ হয়। যেমন – কাক>কাগ, গলাব>গোলাপ। |
|
সঘোষ মহাপ্রাণ বর্ণ সঘোষ
অল্পপ্রাণ বর্ণে পরিণত হয়। যেমন – ভাই > বাই, ভাত>বাত। |
অল্পপ্রাণ বর্ণ মহাপ্রাণ বর্ণে উচ্চারণের প্রবণতা দেখা
যায়। যেমন – ধূর>দূর। |
সঘোষ মহাপ্রাণ ধ্বনি
শব্দের আদিতে রক্ষিত হলেও অন্যত্র অল্পপ্রাণ হয়ে যায়। যেমন – বোঝা।বোজা, সমঝা>সম্জা। |
ল কোথাও কোথাও ন রূপে
উচ্চারিত হয়। |
জ (j) প্রায়ই জ (z) এবং র স্থলে অ, অ স্থলে র উচ্চারিত
হয়। যেমন- রাম>আম, রস>অস, আম>রাম। |
স, শ, স্থানে ‘হ’ হয়।
যেমন- সে>হে, বসো>বহো। |
|
ল>ন কিংবা ন>ল
হয়। যেমন – লাল>নাল, জননী>জলনী, সিনান>সিলান। |
|
|
|
|
শব্দের আদিতে র ধ্বনির
লোপ ঘটে। যেমন – রাজা>আজা, রাতি>আতি। |
রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যঃ
রাঢ়ী |
বরেন্দ্রী |
বঙ্গালী |
ঝাড়খণ্ডী |
কামরূপী |
কর্তা ছাড়া অন্যকারকে
বহুবচনে ‘দের’ বিভক্তি। যেমন- আমাদের জল দাও। |
কর্তৃ কারকের বহুবচনে ‘গুলি’র স্থানে ‘গিলা’ বা ‘গলান’
এর প্রয়োগ। যেমন – বাঁদরগিলা>বান্দরগিলা, আমগুলি>আমগলান। |
কর্তায় ‘এ’ বিভক্তি।
যেমন- রামে খায়। কর্তৃ কারক ছাড়া অন্য
কারকের বহুবচনে ‘গো’ বিভক্তি। যেমন – তোমাগো, হামাগো। |
|
কর্তায় বহুবচনে ‘লা’
বিভক্তি হয়। যেমন- মানসিলা। |
অধিকরনে ‘এ’, ‘তে’ বিভক্তি।
যেমন- বনে থাকে। জমিতে চাষ করে। |
কখনও কখনও অধিকরণে ‘ত’ বিভক্তি। যেমন- ঘরত যা। |
অধিকরণে ‘ত’ বিভক্তি।
যেমন- ঘরত যা।বাড়িত থাকুম। |
অধিকরণএ ‘অ’ বিভক্তি। যেমন- রাইত ছিলি কোথায়? |
|
সদ্য অতীতকালের উত্তম
পুরুষের বিভক্তি হল ‘লুম’। যেমন- আমি বললুম। |
উত্তম পুরুষে ‘মু’/ ‘মো’ বিভক্তি। যেমন- খোরাক পামু। গাও
ধোমো। |
সদ্য অতীতকালের উত্তম
পুরুষের বিভক্তি হল ‘লাম’। যেমন- আমি বললাম/খাইলাম। |
|
ভবিষ্যৎ কালের উত্তম
পুরুষে ‘ম’ বিভক্তি। যেমন- এলা মিটিঙৎ যাম। |
|
মধ্যম পুরুষে সাধারনে ‘বা’ তুচ্ছার্থে ‘বউ’ বিভক্তি। যেমন
– যাবা, পারবু। |
|
|
অতীতকালে ও ভবিষ্যৎকালের
মধ্যমপুরুষে ‘উ’ বিভক্তি। যেমন- মোক ভুলালু রূপার খারু দিয়া। |
|
প্রথম পুরুষে ‘বি’ বিভক্তি। যেমন- তোর ছাওয়ালের বিয়া হবি।
|
|
|
ভবিষ্যৎ কালের প্রথম
পুরুষে ‘বে’ বিভক্তি। যেমন- ছুয়ালা মোর না খাই মরিবে। |
মূল ধাতুর সঙ্গে ‘আছ’
ধাতুর যোগ করে কাল ও বিভক্তি যোগে ক্রিয়ার রূপ গঠিত হয়। যেমন – কর+ছি(আছ)= করছি,
|
|
ক্রিয়ারূপের প্রধান বৈশিষ্ট্য
রাঢ়ীর সাধারণ বর্তমানের রূপ এখানে ঘট্মান বর্তমান । যেমন – মায়ে ডাকে। |
যৌগিক ক্রিয়াপদে কোথাও ‘আছ’ ধাতুর পরিবর্তে ‘বট’ ধাতুর
প্রয়োগ হয়। যেমন – কবি বটে। ও রাজা বটে। |
নেতিবাচক বাক্যে ক্রিয়াপদের
আগে ‘না’ এর ব্যবহার দেখা যায়। যেমন – না-যাও। না-লেকিম। না-দেখিম। |
|
কর্মকারকে ‘ক’ বিভক্তি। যেমন – মাঝিক<মাঝিকে |
|
নঞর্থক অব্যয় ক্রিয়াপদের পূর্বে বসে। যেমন – নাই হয়। নাই
দিলি। |
কর্মকারকে ‘ক’ বিভক্তি।
যেমন – মোক<আমাকে |
No comments