কলিঙ্গ দেশে ঝড়বৃষ্টি
কলিঙ্গ দেশে ঝড়বৃষ্টি
মুকুন্দরাম চক্রবর্তী
রচয়িতার পরিচয়ঃ
বাংলা সাহিত্যে মুকুন্দরাম চক্রবর্তী মধ্যযুগের কবি। তিনি কবি কঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী নামেও পরিচিত।
ধারণা করা হয় তার জন্ম ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম
দিকে (আনুমানিক ১৫৪০-১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে) বর্ধমান জেলার
দামুন্যা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কবির পিতার নাম হৃদয় মিশ্র ও মাতার নাম দৈবকী। তার বিখ্যাত কাব্য চণ্ডীমঙ্গলকাব্য। এর রচনাকাল আনুমানিক ১৫৭৭ খ্রীস্টাব্দে।
ডিহিদার মামুদ শরিফের অত্যচারে উৎখাত হয়ে আনুমানিক ১৫৭৫ খ্রিষ্ট্রাব্দে
মুকুন্দরাম পৈতৃক নিবাস ত্যাগ করে মেদিনীপুর জেলার আড়রা গ্রামে আশ্রয় নেন। সেখানে গ্রাম্য জমিদার বাঁকুড়া রায়ের
দ্বারস্থ হন।
কবির প্রতিভার স্বীকৃতিস্বরূপ
জমিদার বাঁকুড়া রায়ের পুত্র রঘুনাথ রায় তাকে কবি কঙ্কণ উপাধি প্রদান করেন। তাঁর রচিত চণ্ডীমঙ্গল কাব্যটি
‘অভয়ামঙ্গল’, ‘অম্বিকামঙ্গল’, কবিকঙ্কন চন্ডী’ ইত্যাদি নামেও পাওয়া যায়।
'কবিকঙ্কণ' কথার মানে যে কবি হাতে অথবা পায়ে ঘুঙুর
পরে গান করতেন। অর্থাৎ মঙ্গলকাব্যের পেশাদার গায়ক।
২। পাঠের উৎসঃ
‘কলিঙ্গদেশে
ঝড়-বৃষ্টি’ কবিতাটির উৎস চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের ‘আখেটিক খন্ড’। কবিতাটি মূল গ্রন্থে
‘কলিঙ্গদেশে ঝড়-বৃষ্টি আরম্ভ’ নামে পরিচিত।
বিষয়বস্তুঃ
কলিঙ্গের আকাশে ঘন মেঘে চতুর্দিক অন্ধকারাচ্ছন্ন।
কেউ কারো অঙ্গ দেখতে পায় না। ঈশান অর্থাৎ উত্তর-পূর্ব
কোণে ঘনঘন বিদ্যুতের ঝলকানি দেখা যায়। উত্তরের প্রবল বাতাসে মেঘের গম্ভীর গর্জন শোনা
যায়। মুহূর্তের মধ্যেই কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে যায় এবং মুষলধারায় বৃষ্টি শুরু হয়।
সমগ্র কলিঙ্গের আকাশে মেঘ গর্জন করে। বিপদের আশংকায় প্রজারা বাড়ি ছেড়ে দৌড়ে পালাতে
শুরু করে। সবুজ গাছপালা ধুলায় ঢেকে যায়। ঝড়ের তাণ্ডবে খেতের ফসল নষ্ট হতে দেখে প্রজারা
ভয় পায়। মনে হয় চারটি মেঘ আটটি বিশাল হাতির সমান অবিরাম বৃষ্টি দেয়। চারিদিকে ব্যঙের
মত বাজ পরে। হাতির সুরের ন্যায় জলধারায় কলিঙ্গের পথঘাট হারিয়ে গেল। ঘনঘন মেঘের গর্জনে
কেউ কারো কথা শুনতে পায় না। দিন-রাত্রির পার্থক্যটাও
বোঝা যায় না। বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে সকল কলিঙ্গবাসী
ঋষি জৈমিনিকে স্মরণ করে। প্রব্ল তুফান ও মেঘের গর্জনে কেউ কারো কথা শুনতে পায় না। গর্ত
ছেড়ে সাপ জলে ভেসে বেড়ায়। কলিঙ্গদেশের জল-স্থল সমান হয়ে যায়। অনবরত সাত দিনের বৃষ্টিতে
শস্য, ঘরবাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। ভাদ্র মাসের পাকা তালের মতো শিল ঘরের চাল ভেদ করে মেঝেতে
পড়তে থাকে। দেবী চন্ডীর আদেশে বীর হনুমান সবকিছু ভেঙে তছনছ করে। পর্বতের সমান জলের
ঢেউয়ে ঘরবাড়ি ভেঙে যায়। চণ্ডীর আদেশে নদনদীগুলিও বইতে থাকে। শ্রীকবিকঙ্কন “অম্বিকামঙ্গল”-এর
গান রচনা করে।
গুরুত্বপূর্ণ শব্দার্থঃ
কৈল— করিল
চিকুর– কেশ বা চুল
নিমিষেকে— নিমেশের মধ্যে
গগন— আকাশ
চারি মেঘ– সম্বর্ত,
আবর্ত, পুষ্কর, দ্রোণ এই চার প্রকার মেঘ
নাদ— গর্জন
গণিয়া— বিচার করে
বিপাক— দুর্গতি
রড - দৌড়
আচ্ছাদিত— আবৃত
হরিত— সবুজ বর্ণ
বেঙ্গ-তড়কা— ব্যাঙের
মতো হঠাৎ লাফ দেওয়া
করি— হাতি
মহী— পৃথিবী
সোঙরে— স্মরণ করে
ভুজঙ্গ— সাপ
বুলে— ভ্রমণ করে
নিরবধি— নিরন্তর
আছুক— পড়ে থাকুক
হেজ্যা— পচে যাওয়া
বিদারিয়া— ভেদ করে
মঠ- আশ্রম বা মন্দির
অট্টালিকা— প্রাসাদ
দলমল— টলমল অবস্থা
খান খান— টুকরো টুকরো
ধায়— প্রবাহিত হওয়া
অম্বিকা—– ধৃতরাষ্ট্রের
মাতা, এখানে দেবী চন্ডী
অম্বিকামঙ্গল— দেবী
অম্বিকার পালাগান
টীকা/ব্যাখ্যাঃ
কলিঙ্গ— মধ্য-পূর্ব
ভারতের একটি ইতিহাসপ্রসিদ্ধ অঞ্চল। এই অঞ্চলটি এক সময় ওড়িশা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত
ছিল। তখন এ অঞ্চলের রাজধানী ছিল কলিঙ্গপত্তন। বঙ্গোপসাগরের পশ্চিম উপকূলে গঙ্গানদী
থেকে গোদাবরী নদী পর্যন্ত এই অঞ্চলের বিস্তার ছিলো।
ঈশান— ঈশান শব্দের অর্থ
মহেশ্বর বা শিব। তবে পাঠ্য কাব্যাংশে ঈশান বলতে উত্তর-পূর্ব দিকের কোণকে বোঝানো
হয়েছে। এই কোণের অধিপতি হলেন দেবতা শিব। উত্তর-পূর্ব কোণকে বলা হয় ঈশান,
দক্ষিণ-পূর্ব কোণকে বলা হয় অগ্নি, দক্ষিণ-পশ্চিম কোণকে বলা হয় নৈঋত এবং
উত্তর-পশ্চিম কোণকে বলা হয় বায়ু।
অষ্ট গজরাজ— ‘অমরকোষ'
গ্রন্থে অষ্ট গজরাজ বলতে আটটি হাতির নাম উল্লিখিত হয়েছে। যথাএরাবত, পুন্ডরীক,
বামন, কুমুদ, অঞ্জন, পুষ্পদন্ড, সার্বভৌম এবং সুপ্রতীক। এরা দেবরাজ ইন্দ্রের অষ্ট
হাতি। এই অষ্ট হাতি তাদের শুঁড় দিয়ে পৃথিবীকে ধরে রেখেছে বলে মনে করা হয়।
জৈমিনি— মীমাংসা দর্শন
প্রণেতা মুনি হলেন জৈমিনি। তিনি পঞ্চ বজ্রবারকের অন্যতম। বজ্রপাত হলে সাধারণ মানুষ
তাকে স্মরণ করে।
ভণিতা -- মধ্যযুগীয়
কবিরা তাদের পরিচিতি প্রদানের উদ্দেশ্যে পদের শেষে নিজেদের নাম ও পরিচয় উল্লেখ
করতেন, একেই ভণিতা বলা হয়।
বৈকল্পিক প্রশ্নাবলীঃ
১) কলিঙ্গদেশে ঝড়-বৃষ্টি কবিতার উৎস
ক) চন্ডীমঙ্গল খ) মনসামঙ্গল
গ) অন্নদামঙ্গল
ঘ) শীতলামঙ্গল
২) কলিঙ্গদেশে ঝড়-বৃষ্টি কবিতার কবি হলেন
ক) বিজয়গুপ্ত খ)
মুকুন্দরাম চক্রবর্তী
গ) ঘনরাম চক্রবর্তী ঘ)
শিরাম চক্রবর্তী
৩) ঝড়-বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছিল
ক) বঙ্গদেশে খ) মৈথিলি দেশে
গ) কলিঙ্গদেশে ঘ) গৌড় দেশে
৪) মেঘ কোথায় নিমেষে জড়ো হয়?
(ক) অট্টালিকা পরে (খ)
কলিঙ্গে
(গ) গুজরাটে (ঘ) গগন
মন্ডলে
৫)
মেঘ কোথায় উচ্চনাদে ডাকে?
(ক) অট্টালিকা পরে (খ) কলিঙ্গে
(গ) গুজরাটে (ঘ) গগন
মন্ডলে
৬)
কোন মাসে তাল পড়ে?
(ক)
বৈশাখ মাস (খ) আষাঢ় মাসে
(গ)
আশ্বিন মাসে (ঘ) ভাদ্র মাসে
৭)
ভবন ছেড়ে কে পালায়?
ক) সাপ খ) কবি
গ) রাজা ঘ) প্রজা
৮)
কী উলটে পড়ে?
(ক) শস্য (খ) পাথরের মূর্তি
(গ) গাছপালা (ঘ) ঘরবাড়ি
৯)
ঈশানে উড়িল মেঘ সঘনে চিকুর - ‘ঈশান’ হল –
(ক) উত্তর-পূর্ব কোন (খ)দক্ষিন-পূর্ব
কোন
(গ) উত্তর-পশ্চিম কোন (ঘ) দক্ষিন-পশ্চিম কোন
১০)
মঠ অট্টালিকা ভাঙ্গি করে খান খান।। - কে মঠ অট্টালিকা ভেঙে খানখান করে দিল?
(ক) চন্ডী (খ)
গজরাজ
(গ) প্রবল ঝড় (ঘ) হনুমান
১১)
আকাশের কোন কোণে মেঘ ওড়ে?
ক) ণৈঋতে খ) ঊর্ধ্বে
গ) অগ্নিতে ঘ) ঈশানে
১২)
দেখিতে না পায় কেহ অঙ্গ আপনার।। - অঙ্গ দেখা না পাওয়ার কারণ কী?
(ক) গ্রহণ লেগেছে (খ)
সূর্য ডুবে গেছে
(গ) মেঘ ঢেকে গেছে (ঘ)
রাত্রি হয়েছে
১২)
কলিঙ্গদেশে কতদিন ধরে বৃষ্টি হয়েছিল?
(ক) দুইদিন (খ) সাত দিন
(গ) চার দিন (ঘ) দশ দিন
১৩)
“গর্ত ছাড়ি ভুজঙ্গ ভাসিয়া বুলে জলে’- ‘বুলে’ শব্দটির অর্থ হল
(ক) ঘুরে বেরায় (খ)
বলে বেড়ায়
(গ) খেলে বেড়ায় (ঘ) ভেসে
বেড়ায়
১৪)
‘‘ঈশানে উড়িলো সঘনে চিকুর পরে’’- “চিকুর”
শব্দের অর্থ কি?
(ক) নারকেল (খ) তাল
(গ) বাজ (ঘ) বিদ্যুৎ
১৫)
চাল বিদরিয়া কী পড়ছে?
(ক) তাল (খ) ডাব
(গ) বরফ (ঘ) শিলা
১৬)
একটি প্রচলিত লৌকিক শব্দ হল –
(ক) ঝড় (খ) নিরবধি
(গ) ঈশান (ঘ) রড
১৭)
অম্বিকা মঙ্গল গান কে গেয়েছেন?
(ক) নদ-নদী (খ) বীর হনুমান
(গ) চন্ডী (ঘ) শ্রীকবিকঙ্কণ
১৮)
কলিঙ্গদেশের প্রজারা কাকে স্মরণ করে?
(ক) জৈমিনিকে (খ) দেবী চণ্ডীকে
(গ) কবিকে (ঘ) হনুমানকে
১৯)
কবিতার শেষে কবির নামোল্লেখকে কী বলা হয়?
(ক)
বণিতা (খ) অহংকার
(গ)
প্রকাশ (ঘ) ভণিতা।
২০)
“চারিদিকে বহে ঢেউ” ঢেউগুলির আকার কেমন?
(ক) ছোটো ছোটো খ) তাল গাছের সমান
(গ)
বিশাল পর্বত সমান (ঘ) ভয়ংকর আকৃতির।
No comments