Header Ads

আশাপূর্ণা দেবীর “বলয়গ্রাস”: লীলার আত্ম-অন্বেষণ ও নারী মুক্তির প্রেক্ষিত

 

আশাপূর্ণা দেবীর “বলয়গ্রাস”: লীলার আত্ম-অন্বেষণ ও নারী মুক্তির প্রেক্ষিত

ড. পরিতোষ রায়

 

Abstracts 

আশাপূর্ণা দেবীর “বলয়গ্রাস” উপন্যাসটি টুনি নামের এক সাধারণ মেয়ের শৈশব থেকে যৌবনে লীলা হয়ে ওঠার দীর্ঘ এবং জটিল যাত্রা। তার দীর্ঘ জটিল যাত্রাটি শুধুমাত্র নারীর জীবনের বিবর্তনই নয় বরং একটি পরিবারের এবং সমাজের পরিবর্তনের প্রতিফলন। নারীর ব্যক্তিত্ব আত্মসচেতনতা ও মুক্তির এক অনন্য ভ্রমণ। লেখিকা এতে শৈশবের স্মৃতি ভান্ডার থেকে লীলার জীবনের অস্ফুট জীবন ছবি তুলে ধরেছেন। সেই সূত্রেই টুনি তথা লীলা হয়ে ওঠে। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। লীলার স্মৃতির বিস্মৃত ইতিহাসের অনুসন্ধানে লেখিকা তুলে ধরেছেন টুনির জীবনযাত্রা থেকে লীলা হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া। নারী জীবনের নিগ্রহ, অবদমিত চাহিদা এবং অবশেষে তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ।

“বলয়গ্রাস” উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে। সময়ের দিক থেকে সমাজ ছিল রক্ষণশীল। লেখিকা নিজেও ছিলেন রক্ষণশীল পরিবারের বধূ। জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে সংসার জীবনের উপরের মোহটাকে সরিয়ে ভিতরের সত্যটাকে খুঁজে দেখতে চান। এই উপন্যাসে পুরুষতন্ত্রের প্রাধান্য থাকলেও নারীরাই পৌরুষতন্ত্রের প্রতিনিধিত্ব করেছে। আশাপূর্ণা দেবীর সাহিত্যকে দৃষ্টিভঙ্গি মূলত নারীকেন্দ্রিক। তার লেখার কেন্দ্রে রয়েছে নারীর জীবন, তাদের সংগ্রাম, স্বাধীনতা এবং সামাজিক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই। সমাজের অবহেলিত নারীদের প্রতি তার অগাধ সহানুভূতি ও উপলব্ধি তার সৃষ্টির মুল সুর। প্রথম প্রতিশ্রুতির সত্যর মতো এই উপন্যাসের লীলাও নির্ভিক।   

কেন্দ্রীয় চরিত্র টুনি। এক সাধারণ মেয়ে। যার জীবন শুরু হয় এক প্রথাগত রক্ষণশীল ধনী পরিবারে। টুনির শৈশব সমাজের নির্ধারিত নিয়ম কানুন ও কুসংস্কারের বেড়াজালে আটকে থাকে। মহালক্ষ্মী, তরুবালা ও মনিমালা প্রত্যেকেই তার স্বপ্নগুলোকে অগ্রাহ্য করে। তার জীবন শুরু হয় এক পুতুলের মতো যেখানে তার নিজস্ব চিন্তা ভাবনার কোন স্থান নেই। শৈশবের বিভ্রান্তি আর তরুবালা নির্ভর অবস্থা টুনির ব্যক্তিত্বের বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। তাকে করে তোলে দৃঢ় অভিমানী। আজন্ম অবহেলিত হয়ে শৈশব থেকে যৌবনে উত্তরণ ঘটে। ভাগ্যের করুন অভিঘাতে যৌবনে লীলা হয়ে ওঠে।

Key words: বলয়গ্রাস, আত্মসচেতনতা, আশাপূর্ণা দেবীর, টুনি, রক্ষণশীল, নারীর ব্যক্তিত্ব।

 

 

 

মূল অংশঃ

আশাপূর্ণা দেবীর “বলয়গ্রাস” উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা। এতেতুলে ধরা হয়েছে টুনি নামের এক সাধারণ মেয়ের শৈশব থেকে যৌবনে লীলা হয়ে ওঠার দীর্ঘ এবং জটিল যাত্রা। তার দীর্ঘ জটিল যাত্রাটি শুধুমাত্র নারীর জীবনের বিবর্তনই নয় বরং একটি পরিবারের এবং সমাজের পরিবর্তনের প্রতিফলন।

উপন্যাসটি টুনি থেকে লীলা হয়ে ওঠার ইতিহাস। নারীর ব্যক্তিত্ব আত্মসচেতনতা ও মুক্তির এক অনন্য ভ্রমণ। লেখিকা এতে শৈশবের স্মৃতি ভান্ডার থেকে লীলার জীবনের অস্ফুট জীবন ছবি তুলে ধরেছেন। সেই সূত্রেই টুনি তথা লীলা হয়ে ওঠে। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। লেখিকা বলেছেন – “কেবলমাত্র লীলার স্মৃতি শক্তির ওপর নির্ভর করে বসে থাকলে কাহিনি গতি অচল। লেখনিকেই পাঠাতে হল সেই বিস্মৃত ইতিহাসের অনুসন্ধানে”। সেই অনুসন্ধানে লেখিকা তুলে ধরেছেন টুনির জীবনযাত্রা থেকে লীলা হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া। নারী জীবনের নিগ্রহ, অবদমিত চাহিদা এবং অবশেষে তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ।

“বলয়গ্রাস” উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে। সময়ের দিক থেকে সমাজ ছিল রক্ষণশীল। লেখিকা নিজেও ছিলেন রক্ষণশীল পরিবারের বধূ। জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে সংসার জীবনের উপরের মোহটাকে সরিয়ে ভিতরের সত্যটাকে খুঁজে দেখতে চান। এই উপন্যাসে পুরুষতন্ত্রের প্রাধান্য থাকলেও নারীরাই পৌরুষতন্ত্রের প্রতিনিধিত্ব করেছে। আশাপূর্ণা দেবীর সাহিত্যকে দৃষ্টিভঙ্গি মূলত নারীকেন্দ্রিক। তার লেখার কেন্দ্রে রয়েছে নারীর জীবন, তাদের সংগ্রাম, স্বাধীনতা এবং সামাজিক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই। তার লেখা উপন্যাস ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’, ‘সুবর্ণলতা’ (১৯৬৮) এবং ‘বকুলকথা’ (১৯৭৪) নারীর জীবন ও নারী স্বাধীনতার মাইল ফলক। এই ত্রয়ী উপন্যাস নারীর সামাজিক অবস্থান এবং স্বাধীনতা আকাঙ্ক্ষার এক শক্তিশালী দলিল। তার সাহিত্য মানব জীবনের গভীর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ। নারীর সামাজিক অবস্থান এবং মধ্যবিত্ত সমাজের দৈনন্দিন জীবনের কাহিনী ধারণ করে। অন্যদিকে সময়ের বাস্তবতা এবং চিরন্তন মানবিক অনুভূতির সার্থক প্রকাশ ঘটেছে। এক কথায় আশাপূর্ণা দেবীর জীবন ও সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গি সমগ্র বাংলা সাহিত্যে একটি নতুন মাত্রা করেছে। আসলে সমাজের অবহেলিত নারীদের প্রতি তার অগাধ সহানুভূতি ও উপলব্ধি তার সৃষ্টির মুল সুর। প্রথম প্রতিশ্রুতির সত্যর মতো করে লীলাকে গড়ে তুলতে চেয়েছে। সত্য বলেছে “মেয়ে মানুষ! মেয়ে মানুষ! মেয়ে মানুষ যেন মায়ের পেটে জন্মায় না, বানের জলে ভেসে আসে!” সত্যের মতো লীলাও নির্ভিক।   

বিখ্যাত ত্রয়ী উপন্যাসের পরে প্রকাশিত হয় ‘বলয়গ্রাস’। প্রকাশকাল ১৩৫৬ বঙ্গাব্দ (১৯৪৯)। কেন্দ্রীয় চরিত্র টুনি। এক সাধারণ মেয়ে। যার জীবন শুরু হয় এক প্রথাগত রক্ষণশীল ধনী পরিবারে। লেখিকা টুনির পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন – “মেয়েটার নাম টুনি। নিতান্তই ক্ষীণ আর দূর্বল বলে বোধ হয় বাহুল্যবর্জিত এই নামটা বহাল হয়েছিল তার। কিন্তু ক্ষট করে এতটুকু নামটাও বড় একটা কেউ উচ্চারণ করে না, সকলেই বলে – মেয়েটা। সভ্যতার বালাইও ত্যাগ করে ছুড়িটা বলবার মতো লোকেরও অভাব নেই”।

তার শৈশব সমাজের নির্ধারিত নিয়ম কানুন ও কুসংস্কারের বেড়াজালে আটকে থাকে। মহালক্ষ্মী, তরুবালা ও মনিমালা প্রত্যেকেই তার স্বপ্নগুলোকে অগ্রাহ্য করে। তার জীবন শুরু হয় এক পুতুলের মতো যেখানে তার নিজস্ব চিন্তা ভাবনার কোন স্থান নেই। শৈশবের বিভ্রান্তি আর তরু বালা নির্ভর অবস্থা টুনির ব্যক্তিত্বের বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। তাকে করে তোলে দৃঢ় অভিমানী। আজন্ম অবহেলিত হয়ে শৈশব থেকে যৌবনে উত্তরণ ঘটে। ভাগ্যের করুন অভিঘাতে যৌবনে লীলা হয়ে ওঠে। ধনী বিধবা মহালক্ষ্মীর একমাত্র কন্যা মনিমালার কুমারী কালের মেয়ে হয়েও তরুবালর আশ্রয়ে থাকতে হয়েছে। উপেক্ষিতা শিশুর সকল যন্ত্রণাই উপভোগ করতে হয়েছে। আসলে কুমারী কালের অপবাদ ঢাকতে মহালক্ষ্মী তাকে আশ্রয় দেন বিধবা ভাইজি তরুবালার আশ্রয়ে। মহালক্ষ্মী সামাজিক সম্মান ও সংস্কারকে গুরুত্ব দিয়ে নীরবে হত্যা করেছেন টুনির শৈশবকে। কিন্তু উপন্যাসের প্রেক্ষাপটে দেখা যায় টুনি বড় হয়। তার মায়ের আদলটি চেহেরায় ফুটে উঠে। সেটা ঢাকতে মহালক্ষ্মী আরও বেশি বিব্রত হয়। এদিকে অবহেলায় অতিষ্ঠ হয়ে বালিকা টুনি একদিন গৃহত্যাগ করে। নানা ঘাত প্রতিঘাতের পর তার ঠাই হয় বিভাবতী দেবীর অনাথ আশ্রমে। ততদিনে সে যুবতী। ঘটনাচক্রে সেই আশ্রমের আর্থিক সাহায্য দাতা জ্যোতিপ্রকাশ। টুনিরই জন্মদাতা। কিন্তু অপমানাহতা আজন্ম লাঞ্ছিতা  টুনি তাকে চিনতে পেরেও অস্বীকার করে। অভিমানাহত টুনি দৃঢ় মানসিকতায় বলেছে – “বাজে কথা বলছেন কেন? আমি চিনি না আপনাদের - কখনোই না - জীবনেও দেখিনি ... শুধু শুধু ডাকবো কেন? বারবার তো বলছি আমি লীলা। ... টুনি কে আমি চিনি না”।

‘বলয়গ্রাস’ নামটিও যথেষ্ট তাৎপর্যবাহী। ‘বলয়গ্রাস’ শব্দের অর্থ সূর্যের পূর্ণগ্রাস বা গ্রহণ। অর্থাৎ এই গ্রহণে চাদের ছায়া সূর্যের ওপর এমন ভাবে পড়ে যাতে সূর্যের চারপাশে আলোর বলয় দেখা যায়। এই গ্রহণে চাঁদের ছায়া সম্পূর্ণভাবে সূর্যকে গ্রাস করতে পারে না। কিন্তু সূর্যকে মাঝখান ঢেকে ফেলে। আর সেই সময় থেকে আলোকমালা দেখা যায়। ঠিক তেমনি আশৈশব স্নেহ বঞ্চিত টুনি মনিমালার জীবনে অমাবস্যার চাঁদ হয়ে প্রতিভাত হয়েছে। তাদের মাঝে অন্ধকার বলয় সৃষ্টি করেছে। টুনি থেকে লীলায় পরিণত হয়ে বিভাবতীর অনাথ আশ্রমের সহযোগিতায় প্রদক্ষিণ করেছে নিজের জন্মদাতা পিতা-মাতাকে। কিন্তু অপমানে অভিমানে সম্পূর্ণরূপে মেনে নিতে পারেনি। দীর্ঘ বারো বছর পর টুনিকে নিজেদের মেয়ে বলে দাবি করলে টুনি তাদের চিনেও অস্বীকার করে। শোইশবের অসহায় দিনগুলিতে যে মা সন্তানকে অস্বীকার করে তার স্নেহ ব্যাকুল আলিঙ্গন পাশে টুনি ধরা দেয় না। চোখে তার জলন্ত আগুনের দৃষ্টি। টুনি থেকে লীলা হয়ে পরিচয়কে অস্বীকার করে এক যন্ত্রণার বলয় সৃষ্টি করে মনিমালা ও জ্যোতিপ্রকাশের জীবন সংগ্রামের চারপাশে। টুনি তীব্র অভিমান করে বলে উঠে – “আমি চিনিনা আপনাদের - কখনোই না - জীবনেও দেখিনি”।

লীলাকে কেন্দ্র করে বলয় গ্রাস হয়ে উঠেছে আশাপূর্ণা দেবীর নারীর সামাজিক অবস্থান, তাদের সংগ্রাম এবং আত্মসম্মানের জন্য লড়াইয়ের ইতিহাস। সামাজিক কাঠামো ও পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি প্রবল প্রতিবাদ প্রকাশ পেয়েছে লীলার অভিমানের মধ্য দিয়ে। লীলার জীবনের কাল হল মহালক্ষ্মী। মহালক্ষ্মীর অহংকার ও আভিজাত্যের গর্ব টুনিকে লীলায় পরিণত করে। পথে নামতে বাধ্য করে। বাড়ির গিন্নির অতিদূর সম্পর্কের এক ভাইজি তরুবালার মেয়ে টুনি হয়ে করুনার কনায় ধীরে ধীরে পুষ্ট হতে থাকে। জ্যোতিপ্রকাশ ও মনিমালার কৈশোর কালের একটি ভুলকে কোন মতে মেনে নিতে পারেনি। তার ফল ভুগতে হয়েছে টুনিকে। দাম্ভিক আত্মগর্বী মহালক্ষ্মী সন্তান স্নেহের চাইতেও প্রাধান্য দিয়েছে নিজের জেদকে, তার কাল্পনিক আত্মসম্মানকে।

মহালক্ষ্মীকে কেন্দ্র করে লীলার জীবন পথ এগিয়ে চলে। টুনির থেকে লীলা হয়ে যৌবনে উত্তীর্ণ হয়। শৈশবের স্মৃতি থেকে দুটি ছবিকে স্মৃতিচারণ করে। একটি রান্নাঘর অপরটি “উঁচু পালঙ্কের উপর ধবধবে বিছানায় রূপকথার রাজকন্যা মতই একটি মেয়ে”।৬ তবে উপন্যাসটি শুধুমাত্র লীনার স্মৃতিচারণ নয়, সেই বিস্মৃত স্মৃতির অনুসন্ধানও। অভিমানাহত একটি নারীর সামাজিক কাঠামোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহও। অধ্যাপক পবিত্র সরকার বলেছেন - অধ্যাপক পবিত্র সরকার এই উপন্যাসটি সম্পর্কে লিখেছেন, ...নীতি, ধর্ম সমাজের আর শৃঙ্খলার গায়ে ছোবল মারার ব্যাপক সম্ভাবনাকে লেখিকা সংহত করেছেন তীব্র এক ব্যক্তিগত অভিমানের মধ্যে। এই অভিমানটির খবর আমরা আগে পাইনি আমাদের সাহিত্যে।... ওই অভিমানকেই হয়তো আমাদের সম্মান করা উচিত, আর ঘৃণা করা উচিত সেই প্রথাকে যা এই অভিমানের জন্ম দিতে পারে। কোনো প্রচার নয়, বক্তৃতা নয়, ধিক্কার নয়, শুধু একটি মেয়ের গল্প বলে লেখিকা আমাদের মনের মধ্যে যে প্রশ্ন তুলে দেন সে প্রশ্ন তার সংগত উত্তরের জন্য আমাদের নিরন্তর উৎপীড়িত করতে থাকবে। লেখিকার ক্ল্যাসিকগুলি – তাঁর ট্রিলজি – তো আছেই, কিন্তু ‘বলয়গ্রাস’ও চিনিয়ে দেয় একজন জাত লেখিকাকে, নির্মমতা যাঁর অন্যতম অস্ত্র। এই উপন্যাসে লীলা শৈশবে টুনি নামে পরিচিত। বাড়ির কর্ত্রী মহালক্ষ্মীর পরিকল্পনায় টুনি পরিচয় পায় তার ভাইঝি তরুবালার মেয়ে হিসেবে। কিন্তু কোন ভাবেই তরুবালার সঙ্গে টুনির মিল থাকে না। অথচ জোরপূর্বক মানানো হয়। সেখানেই শুরু হয় জটিলতা।

উপন্যাসের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হল পৌরুষ মানসিকতা। নিয়মের নিগড়ে আচ্ছন্ন সমাজ বাস্তবতার প্রতি লেখকের তীক্ষ্ণ সমালোচনা। কিন্তু এই পৌরুষ মানসিকতার মূলে আছে নারী। নারীর এমন এক মানসিকতা যা অন্য নারীকেও দমে রাখে। মানসিক দ্বন্দ্বের শিকার হতে বাধ্য করে। মহালক্ষ্মী ও বীনাপানি দেবী সেই মানসিকতার ধ্বজাধারী। একভাবে দেখলে মনে হবে সমগ্র উপন্যাসটি পুরুষ বর্জিত। এখানে নারীদেরই প্রাধান্য বেশি। সরকার মশাই আর রবিনবাবুকে বাদ দিলে মহালক্ষ্মীই মনিমালাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। চাপিয়ে দিয়েছে তার নিজস্ব ইচ্ছা-আশা-আকাঙ্ক্ষাকে মণির উপর। মনির কোন স্বপ্ন বা ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষাকে গুরুত্ব দেয়নি। মনিও শারীরিক অসুস্থতায় নিরবে নিজের অস্তিত্বকে খুঁজেছে। জোরালো প্রতিবাদ করেনি কারণ “মহালক্ষ্মী যদি একবার কিছু মনস্থ করে থাকেন, মণির কি সাধ্য তাকে রদ করবার! ...  এখন মহালক্ষ্মীর সুমতির জনয ভগবানের কাছে প্রার্থনা করা ভিন্ন আর কি করবার আছে মণির?”

মহালক্ষ্মী প্রত্যেক বিষয়ে মেয়ের অনুমতি নিতে চান না। মেয়ের জন্য মরতে পারেন, বাঁচতে পারেন, তবুও তার কথা সীমালঙ্ঘন বা কাজের প্রতিবাদ সহ্য করতে পারেন না। এই কারণে জ্যোতিপ্রকাশের খবর বইয়ে আনা সরকার মশাইকেও দমিয়ে রাখেন। দ্বিতীয়বার মনির বিয়ের আয়োজন করেন। কাকা বিশ্বনাথ বাবুকে দিয়ে পাত্র পক্ষের দেখাশোনার আয়োজন চলতে থাকে। এখানে লেখিকা বিংশ শতাব্দীর কলকাতা শহরের পরিবর্তিত সময়ের কথা তুলে ধরেছেন। গ্রামের থেকে শহরের মেয়েদের বিয়ের বয়সে যে হেরফের আছে তার ইঙ্গিত দিয়েছেন। কম বয়সে যেখানে মেয়ের বিয়ে দেওয়া হয় সেখানে ২২ থেকে ২৪ বছর বয়স কলকাতা শহরে কোনো ব্যাপারই না। পরিবর্তিত সময় ও সমাজের নারীদের চরিত্রগত দৃষ্টিভঙ্গিতেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। তবে মনে দ্বিতীয় বার বিয়েতে অস্বীকার করেছে বলেছে – “কিন্তু মা, যা হয় না, হতে পারে না, হওয়া অসম্ভব – সেটা কি করে সম্ভব হতে পারে?” মহালক্ষ্মী গম্ভীর ও দৃঢ় ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে  - “প্রত্যেক বিষয়ে তোমার অনুমতি নিয়ে কাজ করা আমার পক্ষে কষ্টকর”।১০

মহালক্ষ্মীর সোমবারের কলকাতা যাত্রাকে কেন্দ্র করে টুনি প্রথম পথে নামে। চার দেওয়ালের বাইরে – “চারখানা-চাকাওয়ালাএকটা ছোট্ট ঘরের মধ্যে চড়ে বস্লে যে এতো স্ফুর্তি লাগে এ কথা আগে কে জানত? ... এতো লোক কেন? ... কিন্তু এ কি! এ কি! কৌতূহলী দুই চোখ মেলে দেখতে না দেখতে টুনিকে উড়িয়ে নিয়ে গেল যে! ...  উত্তেজিত শিশুমন প্রশ্নে মুখর হয়ে ওঠে – মা মা, ওতা কি? ওতা?” ১১  টুনির জীবন তখন তখনই বিবর্তিত ও রূপান্তরিত হতে শুরু করে যখন সে তার নিজের প্রতি এবং চার মাসের সমাজের প্রতি প্রশ্ন তুলতে শেখে। কিন্তু তরুবালা জোর করে কৌতূহল প্রশমিত করে দেয়। এমনকি সরকার মশাইকেও নিষ্ক্রিয় করে দেয়। প্রকৃতপক্ষে তরুবালার মা নয়, মেয়ের মর্ম বুঝবে কীভাবে! টুনির সঙ্গে তার দেখানো সম্পর্ক নাড়ির কোন যোগ নেই। আন্তরিকতার কোন প্রশ্নই আসে না। কিন্তু টুনির – “সবই নতুন সবই রহস্যময়। সমস্তই উত্তেজনাকর”১২ অন্যদিকে মহালক্ষ্মীর নিপুন ব্যবস্থায় কলকাতার এই নতুন বাসায় বামুন, চাকর, আসবাবপত্র, সংসার যাত্রার খুঁটিনাটি কোনো উপকরণেরই অভাব হয় না এখন সব সার্থক হয় মনি সেরে উঠলে। ম্নির কাছে মৃত্যু হার মেনেছে কিন্তু পরাজিত হয়েছে তুমি মাতৃস্নেহ, উপেক্ষিত হয়েছে টুনি। মাতৃস্নেহ বঞ্চিত টুনি হয়েছে নিরাশ্রয়।

টুনি থেকে লীলা হয়ে ওঠার যাত্রা শুরু হয় তার নিজের মনের গভীর উপলব্ধি থেকে। তাকে যখন কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় তখনই টুনি অবাক হয়, নতুন পথ খুঁজে। ঠাকুর বাড়ির রহস্যময় মহলটার প্রতি আকর্ষণবোধ করে। সমস্ত বাধা শৃঙ্খল ছিড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজে। তার বুদ্ধির কথা ভেবে নীরদা অবাক হয়ে তরুকে বলে – “তোমার এই ছ-বছরের মেয়ের পেটে তরুদিদিমনি ১৬ বছরের মেয়ের বুদ্ধি! উঃ কি পাকা মেয়ে বাবা, জ্ঞানে টনটনে”। ১৩

উপন্যাসে পরিবার এবং সমাজ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। লীলা হয়ে ওঠার পথে টুনিকে অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। মহালক্ষ্মীর দাম্ভিতায় আর জ্যোতিপ্রকাশ ও মনির একটা ভুলের কারণে টুনিকে পথে নামতে হয়। এই রূপান্তর শুধুমাত্র তার জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনে না বরং তার চেতনায় ও আচরণেও পরিবর্তন ঘটায়। এই জন্য ছত্রিশ বছর বয়সি আশ্রিতা মা তরুবালার বিরুদ্ধে কথা বলে, অভিযোগের সুর তুলে ধরে মহালক্ষ্মীর সামনে। বিনোদের সঙ্গে কথা বলা প্রসঙ্গে মহালক্ষ্মীর সামনে নির্দ্বিধায় বলেই ফেলে – “রোজই তো করে - সামান্য কিছু করে নিয়ে টুনি তাড়াতাড়ি জবাব দেয় - রোজ রোজ সন্ধ্যা বেলা আসে যে বিনোদ, মার সঙ্গে গল্প করতেই তো আসে, চা খায়, পান খায়, মাছ ভাজা খায়”।১৪ এই অভিযোগের ফলও পেতে হয় টুনিকে। তরুবালা ঘুম ভাঙ্গিয়ে জেরা করতে থাকে মারতে থাকে কিন্তু টুনির দৃঢ় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে অটল থাকে। যে মেয়েকে মারতে মারতে যমের দরজা অবধি পাঠিয়ে দিলেও টু শব্দ করে না হাজারটা প্রশ্ন করে নিজের মাথা গরম করে ফেললেও একটি উত্তর দেয় না”।১৫ এই অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতেই রাস্তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বারবার এই কথাই ভাবে টুনি। এত বড় রাস্তা। এখানে নেমে পড়লে জায়গা হয় না তার? ... টুনির রূদ্ধ আবেগ সহসা ভাষায় মুক্তি লাভ করে – “আমি চলে যাব। নিশ্চয়ই চলে যাব”।১৬

মহালক্ষ্মীর ধুরন্দর। পশ্চিম থেকে ফিরে আয় আসা কাকাকে কেন্দ্র করে মনির আবার বিয়ের কথা ভাবে। সাত বছর আগের জ্যোতিপ্রকাশ ও মনিমালার সম্পর্কে অস্বীকার করে, নতুন করে মনির বিয়ের আয়োজন করতে বসে। কাকা বিশ্বনাথ বাবুর সহযোগিতায় যেদিন মনিকে পাত্র পক্ষ দেখতে আসে সেদিনই টুনি পথে নামে। হারিয়ে যায় আরো এক নতুন পথের সন্ধানে। “পথ ... চিরদিন যে হাতছানি দেয় টুনিকে। আপনি অজ্ঞাত কোন রহস্যলোকের বার্তা বহন করে”।১৭ অবশেষে তুমি পথেই বেরিয়ে পড়ে। মহালক্ষ্মী তরুবালা, মনি, নীরদাদের ছেড়ে সাত বছর বয়সে অভিমানকে সম্বল করে নিরুদ্দেশের পথে হাঁটলো সংশয় আর দ্বিধায় লেখিকা বলেছেন – “পথ থেকে কুড়িয়ে নিয়ে গিয়ে টুনিকে দিল আশ্রয়? কে বাঁধলো আবার মিথ্যা পরিচয়ের নতুন ফাঁস? ... মহানগরীর ধূলি ধূসর পথে লক্ষ পদচিহ্নের নিচে কখন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো ছোট ছোট দুখানি পায়ের চিহ্ন”?১৮  

টুনির নিরুদ্দেশে বলয় যেন বাড়তে লাগল। অন্ধকার ধীরে ধীরে ঘনীভূত হতে থাকলো। চারিদিকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলে। টুনি যেন নিশ্চিন্তে অজানার পথে পাড়ি দিল। একদিকে দাম্ভিক আত্মগর্বী মহালক্ষ্মী সন্তান স্নেহের চেয়েও গুরুত্ব দেন নিজের জেদকে, কাল্পনিক আত্মসম্মানকে। অন্যদিকে সুকৃতি দেবী মহালক্ষ্মীর মতো নারী হয়েও সন্তান স্নেহে টুনিকে আঁকড়ে ধরেছে। নিজে বিছানা ছেড়ে উঠতে না পারলেও টুনিকে লীলার মর্যাদা দিয়েছে। তার আত্মসম্মানকে গুরুত্ব দিয়েছে। বিদ্যালয়ে ভর্তি করে আত্মসন্তুষ্টি বোধ করে। যথেষ্ট যোগ্যতারও পরিচয় দেয়। সুকৃতি দেবীর বাড়িতেও যেন তার নিরন্তর যুদ্ধ। সেখানেও নিস্তার নেই লীলার। সেখানে লীলা নাম নিয়ে জীবনের লীলাকে শেষ করতে পারল না। লীলা যেন আরো আবারো জেগে উঠল। “বিস্তৃত স্মৃতি রোমন্থনেও কিছু মাত্র তৃপ্তি নেই। বিধাতার অগাধ নিষ্ঠুরতার সাক্ষ্য দিতেই হয়তো সারা জীবন কেটে যাবে লীলার”।১৯  রেবা ও জয়ন্তকে কেন্দ্র করে সাক্ষাৎ ঘটে বীণাপাণি দেবীর। টুনি জীবনে মহালক্ষ্মীকে পেয়েছে একাধারে শাসক কর্তৃতবাদী সমাজের গোড়ামী ও জেদের বশবর্তী হয়ে সন্তান স্নেহকে বিসর্জন দেওয়াতে। সুকৃতি দেবীর বাড়িতে বীণাপাণিকে পেলেন সেই একই রূপে। বীণাপাণির ছেলে জয়ন্তকে কেন্দ্র করে কৈশোরের রোমান্টিকতায় রং লাগলেও তা আচমকা নিভে যায়। সুকৃতি দেবীর মৃত্যুতে সব আলো যেন নিভে যায়। একদিকে বীনাপাণির অপমান অন্যদিকে সুকৃতি দেবীর মৃত্যু লীলাকে দিশাহারা করে দেয়। ফলে আবার তাকে পথে নামতে হয়। “পথ! ... যে পথ আজীবন দূর্নিবার বেগে আকর্ষণ করেছে লীলাকে। লীলাকে না। অপরের দেওয়া এই লীলার খোলসটার মধ্যে এতদিন যে ঘুমিয়েছিল - সেই টুনি কে? ... কঠিন সংসারের রূঢ় আঘাতে খোলসটা গেল টুকরো টুকরো হয়ে ... আবার চেনা যাচ্ছে টুনিকে। ... পথ তাকে হাতছানি দিচ্ছে। এই পথ তাকে রক্ষা করবে অসম্মান থেকে, বাঁচতে অপমানাহত মুখখানাকে অপমানকারীর দৃষ্টির সামনে দেখিয়ে বেড়ার লজ্জা থেকে”।২০ এই জন্যই টুনির সমস্ত বাধা শৃঙ্খল, আবেগ ঝেরে ফেলে লীলা হয়ে আবারও নেমে পড়ে পথে। খুজে পেতে চায় আত্ম পরিচয়। নিজের সন্ধানে আবারো পথকে বেছে নেয়।

টুনি থেকে লীলা হয়ে ওঠার যাত্রা শুরু হয় তার নিজের মনের গভীর উপলব্ধি থেকে। বাস্তবের কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে লীলা হতে হয়েছে। টুনি থেকে লীলার রূপান্তর শুধু তার জীবন যাত্রায় পরিবর্তন আনে না বরং দৃঢ় ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলে। লীলা চাদের মত মহালক্ষ্মী, জ্যোতিপ্রকাশ ও মনির মাঝখানে এসে মনির জীবনে অন্ধকার বলয় সৃষ্টি করেছে। যেন মধ্যাকর্ষণ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে শেষে মনিমালাকেও তার দিকে আকৃষ্ট করেছে। লীলাকে কেন্দ্র করে মনিমালাও পাগলের মতো আচরণ করেছে।

সুকৃতি দেবীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে বিনা টিকিটে ট্রেনে চড়ে লীলা। সেখানে অপরিচিতের হাত ধরে নবদ্বীপে যায়। ইচ্ছে কলকাতা মুখি হলেও অপরিচিত সুরেনের হাত ধরে নতুন পরিচয় পায়। সুরেন বাবুর নকল পরিচয়টা ছিল এমন – “বর্ধমানে থাকতো লীলা, মা নেই, সম্প্রতি বাবাও মারা গেছেন। সুরেন বাবু তার দাদার বন্ধু; অনেকবার সে দেখেছে সুরেন বাবুকে। পনেরো বছর বয়স লীলার”।২১ যে সুরেন বাবুকে সে কোনদিন দেখিনি। তাকে বরদাস্ত করতে হচ্ছে। মানদা, দুর্গা দেবীর মতো কুটিল কুৎসিত নারীদের সঙ্গে দিন কাটাতে হবে ভেবে গা শিউরে উঠে লীলার। তাই আবারো দেখা যায় – “পথ লীলাকে আবারো টানছে, - দুর্নিবার বেগে টানছে। ... না পালাতেই হবে। যেমন করে হোক। ... সংকল্পের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত আতঙ্ক কমে যায়”।২২ অবশেষে পাপ পুণ্যের কথা না ভেবে মানদার টাকা চুরি করে বেরিয়ে পড়ে লীলা। তবে মানুষের ছদ্মবেশে হিংস্র যেসব জানোয়ারের দল অবাধে বিচরণ করে বেড়ায় মানুষের সমাজে লোক আর ক্ষুধার দমকা হাওয়ায় মাঝে মাঝে উড়ে যায় তাদের ছদ্মবেশ, তাই লীলা কে আমরা বাড়ে বাড়ে দেখতে পাই - অস্বাভাবিক নতুন নতুন পরিবেশের মধ্যে। তাই পথ আর ঘর অবিরাম টানা পোড়েন চলছে। অবশেষে সন্তোষিণীদের বাড়িতে আশ্রয় মিলে। ছেলেমেয়ের দেখাশোনার ভার তার ওপরে। এককথা লীলা হয়ে ওঠে ‘ছেলের ঝি’। এইখানে লীলার জীবন নতুন মোড় পায়।

সন্তোষিনীর ভাগ্নি বিভাবতী রায় একটা স্কুলের মেয়ে হেডমাস্টার্ড। কলকাতায় একটি অনাথ আশ্রম চালায়। সমবয়সী মাসিকে সে ততটা কেয়ার করে না। এই বিভাবতী লীলার জন্য মুক্তির দূত হয়ে আসে। এদিকে সন্তোষিনী লীলা বিহীন সংসার কল্পনায় করতে পারেনা। অপরপক্ষে লীলা কলকাতার কথা জানতে পেরে জাওয়ার জন্য উগ্রীব হয়ে ওঠে। সন্তোষীর অনিচ্ছা সত্ব্যেও লীলা কম্পিত কণ্ঠে বলে উঠে – “আপনার দয়া ভুলবো না কোন দিন। কিন্তু কলকাতা আমায় যেতেই হবে মাসিমা। অনুমতি দিন”।২৩  লীলার চরিত্র যেন স্বাধীনতায় পূর্ণ হয়ে উঠে। কোন বাধনেই যেন বেঁধে রাখা যায় না। টুনির সমস্ত বাধা ও শৃঙ্খল যেন ছিন্ন হয়ে যায়। এই অস্থির যাত্রায় লীলা যেন হয়েও টুনির অবস্থান খুঁজে বেড়ায়। এক অদৃশ্য টানে শিকড়েই নিয়ে যায়।

বিভাবতীর অনাথ আশ্রমে লীলা আস্বাদ পায় ভদ্র আর মার্জিত জীবনের। পেয়েছে শিক্ষা আর শিক্ষিত মানুষের সংস্পর্শ। নিজে অনাথ হয়েও ভার পেয়েছে অনাথ ভবনের, শিশুদের পরিচর্যার। সেখানে অনাথ লীলা থেকে সহজে হয়ে উঠে লীলাদিতে। সকলের পছন্দের লীলা অনাথ ভবনে একছত্র আধিপত্য বিস্তার করে। এই অনাথ ভবনেই সাক্ষাৎ হয় জ্যোতিপ্রকাশের সঙ্গে। সেই তার জন্মদাতা পিতা।

লীলার জীবনটা যেন সিনেমার ছবি। নিজেই দেখতে পায়, পরতে পরতে অসংখ্য সংগ্রাম, বিবর্তন, উত্থান-পতন। বিস্মৃত স্মৃতির অস্ফুট চৈতন্যের দরজায় ঘা দিলে অসংখ্য ছবি ভেসে আসে - বনেদি জমিদারদের পুরনো বাড়ি, মহালক্ষ্মী, তরুবালা, মনিমালা, নীরদা, বামুন ঠাকুর সবাই ভিড় করে পদ্ম পুকুরের সেই ১৩ নম্বর বাড়িতে যেন তাকে তাড়া করে বেড়ায়। তা সত্ত্বেও সুকৃতি দেবীর জন্যই তার মন খারাপ হয়। “কিছু সঞ্চয় রয়ে গেছে সেইখানে। কিন্তু লীলার দুর্ভাগ্যের সঙ্গে ভাগ্যকে জড়িয়ে সুদীর্ঘকাল ধরে শুধু রোগ ভোগেই করলেন। তিনি শেষ পর্যন্ত মরেই গেলেন”।২৪  

তবে জ্যোতি প্রকাশ অনাথ ভবনে এসে লীলার খোঁজ নিলেই লীলার চমকে উঠে। তাকে দেখে প্রথম প্রথম কৌতূহলী হলেও পরে বিভাবতীর চাপে নিস্প্রভ হয়ে পরে। জ্যোতি প্রকাশ নিজেই পরিচয় পেতে চায়। কিন্তু লীলা কোন কথার উত্তরই ভালো ভাবে দেয় না। পদ্মপুকুর, নীরদা, তরুবালা, সুকৃতি দেবী ও জয়ন্ত কাউকেই সে স্বীকার করে না। একেবারে হতাশ হয়ে জ্যোতি প্রকাশ নিজের অপরাধ ও মনির পাগলামির কথা বলে বিভাবতীর কাছে ক্ষমা চায় এবং তাদের হারিয়ে যাওয়া ছোট মেয়েটির নামে অনাথ ভবনের নাম ‘টুনি স্মৃতিভবন’ রাখতে চান। লীলা বুঝেও না বুঝার ভান করে পরোক্ষভাবে স্বীকার করে। কিন্তু অভিমানে রাগে পরিচয় জেনেও লীলা টুনি হতে পারল না। অবশেষে মহালক্ষ্মীর কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করে পরোক্ষে লীলার তত্ত্বাবধানেই টুনিও যেন বেঁচে থাকলো অনাথ ভবনের চারিদিকে। শেষে মিসেস মুখার্জি অর্থাৎ মনি এলেও লীলা তার পূর্ব পরিচয়কে অস্বীকার করে। অভিমানে বলে চলে – “বার বার তো বলছি আমি লীলা। টুনি কে? টুনি কে চিনি না আমি”।২৫

টুনি থেকে লীলার জীবন পরিক্রমায় ‘বলয়গ্রাস’ উপন্যাসটি শুধুমাত্র একটি উপন্যাসের কাহিনীতে সীমাবদ্ধ থাকে না। একটি আধুনিক সমাজের প্রতিবিম্ব হয়ে ওঠে। ছোট্টো টুনির জীবন লীলা যেন অসংখ্য মেয়ের জীবন লীলার প্রতিবিম্ব। লীলার দৃঢ়তা ও অভিমান প্রথাগত সমাজ ব্যবস্থার সংকীর্ণতাকে আঘাত করে। একই সঙ্গে স্বাধীন সত্তার জাগরণে আধুনিকতার সম্ভাবনাকে উস্কে দিতে থাকে। সুতরাং আশাপূর্ণা দেবীর ‘বলয়গ্রাস’ উপন্যাসে টুনির লীলা হয়ে উঠার কাহিনি শুধু একটি নারীর গল্প নয়। সামাজিক বাধার বলয় ভেঙ্গে এগিয়ে যাওয়া অসংখ্য মেয়ের কাহিনি। তবে লীলার জীবন সংগ্রাম দেখায় কীভাবে প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রাম করে নিজের জায়গা তৈরি করে নেওয়া যায়। তাই পরিশেষে বলতে হয় যে, জীবন কখনো কোনো বলয়গ্রাসে আবদ্ধ থাকতে পারে না, বরং তা উন্মুক্ত আকাশে পাখা মেলার ক্ষমতা রাখে।

 

**********

 

তথ্যসুত্রঃ

১. দেবী আশাপূর্ণা, বলয়গ্রাস, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ৭৩, ২০১৬, পৃষ্ঠা সংখ্যা – ৭।

২. দেবী আশাপূর্ণা, প্রথম প্রতিশ্রুতি, মিত্র ও ঘোষ প্রকাশনী, চৌষট্টি মুদ্রণ, অগ্রাহায়ণ ১৪১৯, কলকাতা, পৃষ্ঠা সংখ্যা – ২৯।

৩. দেবী আশাপূর্ণা, বলয়গ্রাস, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ৭৩, ২০১৬, পৃষ্টা সংখ্যা – ৭।

৪. তদেব, পৃষ্ঠা সংখ্যা – ১০৭।

৫. তদেব, পৃষ্ঠা সংখ্যা – ১০৭।

৬. তদেব, পৃষ্ঠা সংখ্যা – ৬।

৭. সরকার পবিত্র, ভূমিকা : আশাপূর্ণা দেবী রচনাবলী, প্রথম খণ্ড, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ২০০০, পৃষ্ঠা xxii-xxiii

৮. দেবী আশাপূর্ণা, বলয়গ্রাস, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা - ৭৩, ২০১৬, পৃষ্টা সংখ্যা – ২৮।

৯. তদেব, পৃষ্ঠা সংখ্যা – ২৮।

১০. তদেব, পৃষ্ঠা সংখ্যা – ২৮।

১১. তদেব, পৃষ্ঠা সংখ্যা – ১৪।

১২. তদেব, পৃষ্ঠা সংখ্যা – ১৫।

১৩. তদেব, পৃষ্ঠা সংখ্যা – ১৮।

১৪. তদেব, পৃষ্ঠা সংখ্যা – ১১।

১৫. তদেব, পৃষ্ঠা সংখ্যা – ২৮।

১৬. তদেব, পৃষ্ঠা সংখ্যা – ২৮।

১৭. তদেব, পৃষ্ঠা সংখ্যা – ৩০।

১৮. তদেব, পৃষ্ঠা সংখ্যা – ৬৮।

১৯. তদেব, পৃষ্ঠা সংখ্যা – ৬৯।

২০. তদেব, পৃষ্ঠা সংখ্যা – ৯৬।

২১. তদেব, পৃষ্ঠা সংখ্যা – ১১৬।

২২. তদেব, পৃষ্ঠা সংখ্যা – ১১৮।

২৩. তদেব, পৃষ্ঠা সংখ্যা – ১২৭।

২৪. তদেব, পৃষ্ঠা সংখ্যা – ১৩৬।

২৫. তদেব, পৃষ্ঠা সংখ্যা – ১৪৩।

 

 

সহায়ক গ্রন্থঃ

১. আর এক আশাপূর্ণা, আশাপূর্ণা দেবী, বলয়গ্রাস, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, দ্বিতীয় মুদ্রণ, বৈশাখ - ১৪০৪।

২. আশাপূর্ণা দেবী, উপাসনা ঘোষ, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, প্রথম প্রকাশ, জানুয়ারি – ২০০৪।

৩. বঙ্গসাহিত্যের উপন্যাসের ধারা, শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, মডার্ণ বুক এজেন্সী প্রাঃ লিঃ কলকাতা, ষষ্ঠ সংস্করণ ১৩৮০।

৪. আশাপুর্ণাঃ নারী পরিসর, সম্পাঃ তপোধীর ভট্টাচার্য, বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, বইমেলা ২০০৯।

৫. প্রথম প্রতিশ্রুতি, আশাপূর্ণা দেবী, মিত্র ও ঘোষ প্রকাশনী, চৌষট্টি মুদ্রণ, কলকাতা, অগ্রাহায়ণ ১৪১৯।

৬. সাহিত্য আকাশ, আশাপূর্ণা দেবী সংখ্যা, শারদীয়া ১৪০২।   

 

লেখক পরিচিতিঃ

ড. পরিতোষ রায়

জন্ম ইংরেজি ৭ই মার্চ ১৯৮৯, কোচবিহার জেলার হলদিবাড়ি থানার অন্তর্গত পারমেখলিগঞ্জ গ্রামে। পিতা ভুপেন্দ্রনাথ রায়, মাতা শর্মিলা রায়। সাহিত্যানুরাগী। বাংলা সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকত্তোর। আসাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি. এইচ. ডি. ডিগ্রী অর্জন। বর্তমানে মরিয়ম আজমল ওমেন্স কলেজ অফ সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, হোজাই, আসামে কর্মরত। সমাজ ও সমাজের বাস্তবতা নিয়ে গবেষণামূলক কাজ লেখকের ভালো লাগার জায়গা। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি, গ্রন্থপাঠ এবং ভ্রমণ করা লেখকের অন্যতম শখ।  

 



No comments

Powered by Blogger.