“বেদনার বাঁশি”: একটি বিশ্লেষণী পাঠ
“বেদনার বাঁশি”: একটি বিশ্লেষণী পাঠ
যিনি লেখেন তিনিই লেখক। এই কথাটা
সহজে উচ্চরণ করা যায় ততটা অর্থগত দিক থেকে সহজ নয়। এই বাক্যের তাৎপর্যগত অর্থ
অনেক। প্রতিনিয়ত অনেকেইতো অনেক কিছু লিখি, লিখে রাখি। তাই বলে
সবাইকে লেখক কবি সাহিত্যিক বলা যায় না। কবি জীবনান্দ দাশ বলেছেন যে সকলে কবি নয়,
কেউ কেউ কবি। এই কথা টার তাৎপর্যগত ভাবনা থেকেই বোঝা যায়। লিখলেই
কবি বা সাহিত্যিক হওয়া যায় না। লেখায় কিছু ভাব ভাবনার প্রয়োজন হয় লেখক
সাহিত্যিক বা কবি মনোভাবাপন্ন মানসিকতায় সমাজকে দেখাতে হয়। নিজের ব্যক্তিগত
দর্শনে সুপরিকল্পিত ভাবে সকলের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠা করাতে হয়।
পাঠক যাতে বুঝতে পারে যিনি লিখেছেন তার নিজের কথাই লিখেছেন। মনের আনন্দ বেদনা দুঃখ
কষ্টগুলিকে ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। সেই ভাবনাই
বা কৌশলই লেখক সাহিত্যিককে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। চিরস্থায়ী আসন লাভে সাহায্য সমর্থ
হয়।
“বেদনার বাঁশি” প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ। ৪৭টি কবিতা সংকলিত একটি
কাব্যগ্রন্থ। কবি সুকুমার রায়। জন্ম- ৫ই আগস্ট ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার
হলদিবাড়ি ব্লকের পারমেখলিগঞ্জ গ্রামে।
চলমান জীবন যাত্রায় সুকুমার রায় নীল ছদ্মনামে লেখালেখি করতে ভালোবাসে। খুব কম
বয়স থেকেই লেখালেখি করেন। গ্রামের কামাতবিন্দি জি.পি. স্কুলে পড়াশুনা শুরু করে,
দেওয়ানগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পড়া শেষ করেন
এবং বাড়ির অদূরে নেতাজি সুভাষ মহাবিদ্যালয়ে স্নাতক করেন। সাহিত্য আলোচনা ও সাহিত্য
পাঠে বিশেষ ভাবে অনুরাগী। ছোটবেলা থেকেই কবি নিজেকে কবি
হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সদাই তৎপর হন। সেই চেষ্টা ও নিরলস
পরিশ্রমের ফসল হিসেবে “বেদনার বাঁশি” কাব্যগ্রন্থ বহিঃপ্রকাশ। আশাপূর্ণা দেবীর “জ্ঞানচক্ষু” গ্রন্থের তপনের মতো লেখক কবি সম্পর্কে তার বিষ্ময়কর আগ্রহ ছিল।
কবি সাহিত্যিকদের নিয়ে তিনি অন্তরের গভীর সমবেদনা প্রকাশ করতেন। তারা কী ভাবে
একের পর এক ভাবনাকে প্রকাশ করেন। নিজের হৃদয়ের আকৃতিকে প্রকাশ করে, সমাজ সংসারের সকলের হৃদয়ের আকৃতিতে মিশে যেতেন যে বিষয়ে বিষ্ময়ের সীমা
ছিল না। এমতাবস্থায় তপনের মতো তার একদিন জ্ঞানচক্ষু খুলে যায়; লেখক সাহিত্যিক সম্পর্কে ধারণা মিলে যায়। পরিচিত কয়েকজন সাহিত্য ও
গবেষায়ক আগ্রহী মানুষের সংস্পর্শে এসে। বিশেষত ড.পরিতোষ রায়, তাপস রায়, সপ্তশ্রী কর্মকার প্রমুখদের সহযোগীতায়।
নিজের হৃদয়ে আকুতি, ব্যথা বেদনা, রাগ
অনুরাগকে প্রকাশ করতে গিয়ে প্রথমে ডায়রির সহযোগিতা নেন। সেই ডায়রির এলোমেলো
লেখাগুলিকে ফলের রূপ দেওয়ার কামনা নিয়ে এই ধরনের কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের সাহায্য
নেয়। যেটা আমার অজানা নয়। বিশেষ বিশেষ সাক্ষাৎ করে বা অন্তস্থল আলাপচারিতায় ধরে
আসে সমাজের কথা। সমাজের অবক্ষয়ের জন্য কবি সুকুমার রায় ওরফে
নীল খুবই ব্যথিত। ব্যাথা বেদনার বহিঃপ্রকাশ হিসাবে এই কাব্যগ্রন্থের অবতারণা।
বাংলা
সাহিত্যে আরো একজন কবি আছেন সুকুমার রায় নামে তাকে আমরা চিরস্মরণীয় করে রেখেছি।
তিনি শিশু সাহিত্যিক ও ননসেন্স ছড়ার প্রবর্তক করেছেন। কম বয়সে লেখালেখি শুরু করে
কম সময়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন লেখার কৌশলের গুণে। তেমনি আমার আলোচ্য সুকুমার
রায়ও একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখালেখি শুরু করেন। আধুনিক তথা উওর আধুনিক যুগের
মানুষের মুষ্যত্বকে ধরার চেষ্টা করেছেন। মুষ্যত্বের অভাবে মানুষ সমাজকে অবক্ষয়ের
পথে ঠেলে দিচ্ছে সেই অবক্ষয়ের ভাবনায় কবি সদাই ব্যথিত।
কবি
সমাজকে মানুষের আস্তানা বা বাসকরন অনুপযোগী মনে করেছেন। কারণ মানুষ তার মান হুস
হারিয়ে নিজের বিপদকে নিজের দিকে টেনে আনছে। জীবনের ক্রম পরিণতিকে বিশিয়ে তুলছে।
কবি প্রকৃতিতে সহজ সরল ভাবাপন্ন। মনে প্রাণে প্রকৃতি ও মানুষকে ভালোবাসেন। মানব
সমাজে মানুষের কান্না সহ্য করতে পারেন না। তাই তার কাব্যের বিষয় হয়ে ওঠে মানব
যন্ত্রনা। প্রকৃতির ধ্বংস মুখিনতা। কর্মসূত্রে বিভিন্ন জায়গায় তাকে যেতে হয়।
কখনো হোটেলের সেবাকর্মী হয়ে কিংবা কোম্পানির বিভিন্ন জায়গায় কাজের সুত্রে মানুষের সংস্পর্শে এসে মানুষের মনের গভীরভাবে অনুভব করেন। কবিতা রচনা
কৌশলে সহজ সরল ভঙ্গি অনুসরন করেন। কবিতার ভঙ্গি গদ্য গন্ধি। কথায় কোনো মার প্যাঁচ
নাই। সিধে সাদা সহজ সরল উপস্থাপনে মনের ভাব প্রকাশ করেন। জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে
যতবার বাধার সম্মুখীন হন, ততবারই জীবনের পরিপূর্ণতা দেওয়ার
জন্য কাব্যের কবিতার সাহায্য নেন। আলাপচারিতায় সরল প্রকৃতির মানুষ। মানবিক,
উজ্জ্বল প্রকৃতির। কাজে কবিতায় তার প্রভাব লক্ষ করা যায়। তিনি
কাব্যের নাম দিয়েছেন "বেদনার বাঁশি"।
"বেদনার বাঁশি" কাব্য নামে নিজের অন্তরের বেদনাকে প্রকাশ করলেন।
পাশাপাশি জগৎ সংসারের প্রতিনিয়ত দুঃখ কষ্ট সহ্য করা মানুষের বেদনাকে ও প্রকাশ
করলেন। কবি জগতের চরম অবক্ষয় দেখে ব্যথিত হয়েছেন। সেই ব্যাথা বেদনা থেকে মুক্তি
পেতে স্বাগত করে বলেছেন -
"এসব কথা ভাবছি
মনে
জল
বইছে চোখের পানে।
কবেই
বা আমরা সাধু হবো? "
আমরা বহুবচনে কবি সমাজের
প্রত্যেকেই ইঙ্গিত করেছেন। জগৎ সংসারে নিকৃষ্টতা ও অমানবিক মানসিকতাকে দেখে ব্যথিত
নয়নে অশ্রুধারা বইয়ে দিয়েছেন। সবাইকে সাধু বা সভ্য হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
কবি
বইটি উৎসর্গ করেছেন " সমাজের করুণ নিপীড়িত মানুষদের"। উদ্ধৃত মানুষদের
আশার আলো দেখাতে তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখাতে তার হাতে কলম তুলে দিয়েছেন। কবি
কাজী নজরুল ইসলাম যেমন সমাজের কুসংস্কার ও গোঁড়ামির শৃঙ্খলকে উন্মোচন করার জন্য
কলম হাতে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তেমনি নিপীড়িত মানুষদের বেদনার শৃঙ্খল মোচনের জন্য
কবি সুকুমার রায় হাতে কলম তুলে দিয়েছেন "মানবের তীরে" কবিতায় আক্ষেপে
বলেছেন-
" তুমি যে এক বিশ্ব মানব,
ছুটছে
হয়ে মৃত্যু দানব।"
এই একবিংশ শতকে মানুষ অস্থির হয়ে
উঠেছে। লোভ লালসার দাপটে আত্মনিয়ন্ত্রন হারিয়েছে। জীবনের প্রকৃত অভিব্যক্তি ভুলে
গেছে,
কৃত্রিম সুখকে খুঁজতে গিয়ে সামাজিক সংসারের সম্পর্ক বিসর্জন দিয়ে
বসে আছে। সেটাকে বুঝেও না বোঝার ভান ধরে জীবিত অবস্থায় জড়তা নিয়ে টিকে আছে। কবি
সবাইকে হুঁশিয়ার করে দিতে বলেছে..
"এই মনের অস্তিত্ব বজায় রাখো,
মনের
ক্ষতি সাধনের পথ ত্যাগ করো।"
কবি কাব্যটির মুখবন্ধে বলেছেন –“একবিংশ
শতাব্দীর
প্রেক্ষাপটে
দাঁড়িয়ে
সমাজের
করুন
অবস্থা
লক্ষ্য
করে
আমার
প্রথম
বই
প্রকাশ
করছি। সমাজ
এখন
মৃত্যুর
দোর
গোড়ায়
দাড়িয়ে। আজ
মানুষ
হিংসা
আর
অন্যায়ের
সঙ্গে
লড়তে
লড়তে
সমাজকে
রণক্ষেত্রে
পরিনত
করেছে। ধর্মকে
আজ
মানুষ
অস্ত্র
করে
আঘাত
করছে
মানব
সভ্যতার
বুকে। মানুষ
ভালোবেসে
জয়
করা
ভুলে
গেছে। অন্যায়
ধ্বংসে
মানুষ
নতুন
জয়ের
স্বপ্ন
দেখে। সত্যকে
বোতলে
ঢুকিয়ে
রেখে
ঢাকনি
দিয়ে
রেখেছে,
এর
মাঝেই
চলছে
মানুষের
এক
অন্য
জীবন। আসল
নকলটা
মানুষের
কাছে
জল
ঢালা
দুধের
মতো
হয়েছে,
বোঝাই
যায়
না
আসল
নকলের
রহস্য। খবরের
কাগজ
খুললেই
দেখা
যায়
শুধু
মৃত্যু,
হিংসা,
মারামারি,
রক্তে
রণক্ষেত্রের
খবর। ভালো
খবরতো
প্রায়
শুন্য
হয়ে
গেছে। তাই
মানব
কল্যাণ
সাধনের
তরে
আমার
এই
ছোট্ট
কবিতার
বই
প্রথম
প্রকাশ
করছি। আমার
কবিতায়
তুলে
ধরেছি
সমাজের
মানুষের
মুক্তি। সমাজের
করুন
নিপীড়িত
মানুষের
কথা
নিয়ে
লেখা
এই
বইয়ে
সমাজ
বাস্তবতা
কে
তুলে
ধরার
চেষ্টা
করছি ।”
কবি
আশাবাদী, কাব্যের প্রতিটা কবিতায় তার আশা দীন দরিদ্র,
নিপীড়িত, মানুষ কে জেগে থাকার সাহস জোগাতে
সাহস করে। সকলকে সতর্ক করে দিয়ে কবি বলে উঠে -
"মানুষ সময়ের কাছে আজ্ঞাধারী কাজ করে,.
যে
কর্মেরও ফল থাকে সময়ের করে,
মানুষের
বীরত্বের বিড়ম্বনা।
সময়ের
কাছে সেও এক ক্ষুদ্র বালুকণা ।"
কর্মফল ও সময়ের চরম সত্য মনে করে
কবি সকলকে কর্মফল ও সময়কে চরম সত্য মনে করে কবি সবাইকে সতর্ক করেন। মানবসভ্যতা
কেন বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে যে সেই সময়ের হাত ধরেই এগিয়ে যায়। সময় কাউকেই ছাড় দেয়
না। সময়ের পথে সবাই নগন্য কবি সকলকে স্মরণ করিয়ে দেয়। মহাকালের চরম সভ্যতার কবি
বলতে পারে..
"তোকে ছাড়া এই জীবন
অর্থহীন সমতুল্য বৃষ্টিহীন
তোমাকে আবার ফিরে পাবো এ আশায় দিন কাটি আজো
মরুভূমির মতো ।"
কবি আসলে জীবনকে দরিদ্রতার সাথে
দেখেছেন। কোন আভিজাত্যের স্বচ্ছলতার সাথে উপলব্ধি করেননি। ছোটবেলা থেকেই
দারিদ্রতার সাথে লড়াই করে জীবনের মানে বুঝতে গিয়ে আসল সত্যকে বুঝেছেন। বেঁচে
থাকতে থাকতেও উপলব্ধি করে -
“এটাই কি সত্যি জীবন...
মৃত্যুতেও
যেন হাসে ভুবন?”
এই
হাসি কান্নার জগৎ সংসারে কবি নিজেকে “ কলম সৈনিক” বলেছেন। কলমকে তিনি অস্ত্র
হিসাবে ব্যবহার করে সমাজের জন্য নতুন দিক পরিবর্তনের দিশা দেখাতে চেয়েছেন। তিনি
বলেছেন -
“কবিরা আজ নয়কো ছোটো,
তারাও
আজ এক দেশের সৈনিকের মতো
সমাজের
উন্নতি কাজে,
প্রস্তুত
তারাও আজ কলমের সাজে।
সমাজের
খারাপ কে ধ্বংস করতে,
গুলির
মতোই আঘাত করে, তারা কলমের পাতে।
দেশকে
পুড়ছে যারা আগুন ধূপে,
তাদের
তরে কবি সৈনিক ধরছে অস্ত কলম রুপে।
বিদ্রোহী আজ হয়েছে কবি,
অত্যাচারের শিক্ষার্থে কলম আঁকছে সংগ্রামী ছবি। ”
কবির কাব্য সহজ
সরল ভাষাভাসি অপরিণত। হয়তো এই কাব্য তার কাব্য যাত্রায় সলতে পাকানো কাজ করবে।
উপমার ছাড়াছাড়ি নেই। চিত্র বন্ধের জৌলুষতা ক্ষীণ। কোনো কোনো কবিতায় উপস্থাপনে শিথিলতা চোখে পড়ার
মতো। যেমন - “নিজের রুপে রাজা” কবিতায় শেষ লাইন-“না বদলে, প্রজাই
হবে তোমার সাজা।” লাইনটি একটু হলেও খাপছাড়া। যদিও কবিতায় খাপছাড়া একটা নতুন
শৈলি রায় তাৎপর্যটি বহন করে আনে। তবে সেদিক থেকে খাপছাড়া বলা যায় না।
সাদামাটা
অঙ্গিকের কোনো বিশেষ শৈলি তিনি ব্যবহার করেননি। গদ্যের ঢং এ ভাবনাকে তুলে ধরে।
বৈঠকি রীতি অনুসরণ করার চেষ্টা করেছেন। তবে কাব্য কবিতায় তার সোজা সম্পর্ক রীতিটি
প্রকৃত পক্ষে তার নিজস্ব। এই রীতিটি তাকে নিজস্বতা এনে দেবে। যে যতোই হোক্ কাব্য
কবিতায় সাহিত্য গুনাবলির দিক্ থেকে শিথিলতা চোখে পড়ার মতো। যেমন - কোচবিহার ,ভালোবাসা প্রতিদান, আঁধারের আলো, স্বপ্নের খোঁজে,মানবজাতি, প্রভাত
কবিতায় কবিতার বুননে শিথিলতা চোঁখে পড়ে। কবি প্রথম কাব্যগ্রন্থ তাই ভুল ত্রুটি
কিছুটা হলেও মার্জনীয়। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের বিশাল সম্ভারে স্থান পাবার
ক্ষেত্রে অশান্তি সংকেত যেমন “বিদ্রোহী” কবিতা কাজী নজরুলের মতো নামকরণ করলেও সে
রকম দৃঢ়
চেতা বিদ্রোহের কথা সেভাবে প্রকট হয়নি। হয়তো কবির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মতো সে
বিদ্রোহ ক্ষীণ অনুলীন হয়ে আছে। আর প্রশ্ন কিংবা বিরহজাল কবিতার মতো তার অন্তরাত্ম
বিরহজালে ছটপট করছে।
ড.
পরিতোষ রায়
সাহিত্যানুরাগী,
গবেষক।
No comments