Header Ads

Header ADS

চাঁদ বণিকের পালাঃ যাপিত জীবনের পালা

 

চাঁদ বণিকের পালাঃ যাপিত জীবনের পালা

পরিতোষ রায়

চাঁদ বণিকের পালা নাটকটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে নাটকটির প্রেক্ষাপটে আছে মধ্যযুগীয় মনসামঙ্গল কাব্যের কাহিনি। মনসা ও চাঁদ সদাগরের সংঘাতে কাহিনি। শম্ভু মিত্র মনসামঙ্গলের মনসা-চাঁদের সংঘাতকে কাহিনির প্রেক্ষাপট হিসাবে গ্রহন করলেও শেষ পর্যন্ত একটি আধুনিক যুগযন্ত্রনার ভাষ্য হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। নাটকের শুরুতে চাঁদের নেতৃত্বে সমগ্র চম্পকনগর অভিযানে বের হয়। চম্পক নগরের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করে যৌবন শক্তিতে চম্পকনগরকে সুসজ্জিত করতে চেয়েছে কিন্তু অন্ধকারের অপশক্তি সব শক্তিকে মিয়ে রেখেছে। নানা চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র সত্যম্ শিবম্ সুন্দরম্এর পূজারী চাঁদকে স্তব্ধ করে দিয়েছে

নাটকটির উৎস মধ্যযুগের মনসামঙ্গলের কাহিনি। দেবী মনসার কোপে চাঁদ সদাগরের করুন পরিণতি। দেবী মনসা নিজের আশা-আকাঙ্ক্ষা বা ইচ্ছাকে পূরণ করতে চাঁদ সওদাগরকে ধ্বংস করল অহংকারী জেদি মনসা সরাসরি চাঁদকে আয়ত্তে আনতে না পেরে সুকৌশলে সব অস্ত্র ব্যবহার করেছে এককথায় হাতে মারতে না পেরে ভাতে মেরেছে তার কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছে

এখানে চাঁদ সওদাগর বাংলার চিরযৌবনের প্রতিনিধিত্ব করেছে আমরা জানি বাংলা সারা ভারতে বিপ্লবের আঁতুড়ঘর। সবসময় এগিয়ে ছিল অন্যায় অত্যাচারের প্রতিবাদেপরাধীন ভারতবর্ষে দৃঢ় মানসিকতার ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ করেছিল সেই বাংলায় অন্ধকারের বিরুদ্ধে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। দৃঢ় কণ্ঠে এগিয়ে এসেছে। এটাই স্বাভাবিক অন্ধকার অর্থাৎ সমস্ত অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে গিয়ে আলোর পথের সন্ধান করেছে সেই লক্ষ্যে নাটকের শুরুতে যৌবন জেগে উঠেছে অতীত বাংলার গাঙ্গুর নদীর তীরে চম্পক নগরী যৌবনের প্রতীকচম্পক নগরীসব লোকজন যৌবনের উচ্ছলতায় টগবগ করে উঠেছে। শেষ পর্যন্ত টিকিয়ে রাখতে পারেনি, ধরে রাখতে পারেনি তার যৌবনের শক্তি চক্রান্তকারী শক্তির ষড়যন্ত্রে অস্থির হয়েছে হেরে গিয়েছে অপশক্তির কাছে যুগে যুগে এই অপশক্তি চরম আকার ধারণ করে শুভশক্তিকে বিপর্যস্ত করেছে মনসা। মনসা বেনিনন্দনের কাছে চাঁদ স্তব্ধ হয়ে গেছে যৌবনের প্রতিনিধি চাঁদ যৌবনের ডাক দিতে গিয়ে বাধাগ্রস্থ হয়েছে। প্রতিনিধিত্বকারী উচ্ছ্বাস উল্লাস নিয়ে নতুনের জন্য আহবান করতে পারেনি নাটকের শুরুতে যেভাবে দৃঢ়তার সঙ্গে আশ্বাস দিয়েছিল ভাইসব এট্টা কথা মনে রাখার চাই, যে দিনে রেতে বুকে ভরসা রেখো, আমাদের জয় হবেই হবে’।

সমাজবাস্তবতায় একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে, যেদিকে জল পড়ে সেদিকে ছাতা ধরো। এই মানসিকতাই মানুষকে নতুন কিছু করতে দেয়না। দৃঢ়তার ঙ্গে কিছু করতে দেয় না। সেই মানসিকতা থেকে চোর চুরি করতে বলে আবার সাধুকেও বলে জাগি কেউ দৃঢ়তার সঙ্গে কিছু বলতে পারেনা তখন জোর যার মুলুক তার হয়ে যায় কোন উচিত অনুচিতের বোধ থাকে না দৃঢ়তার সঙ্গে কেউই সত্যকে সত্য বলতে পারেনা মিথ্যাকে নস্যাৎ করে দিয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় প্রতিবাদ করতে পারে না এই কারণে চাঁদের মনে হয়েছে – “সত্যকে মন খুলে বলাই একটা অপরাধ যারা সত্যকে মানেনা, সবকিছুকে তাল মিলিয়ে চলতে চায়, জ্ঞানেরও পূজা করো ফের আবার অজ্ঞানেরও ভজনা করো”। এখানে দেখা যায় মনসামঙ্গলের ছাঁচের বাইরে গিয়ে বেহুলা-লখিন্দরের আত্মহত্যার মাধ্যমে লেখক সেই অজ্ঞানের ইঙ্গিত করেছেন সমকালের প্রেক্ষিতে সমাজ-সংসার ও কূটনৈতিক বিষয়ক তিনি সুকৌশলে ব্যবহার করেছেন

আমরা জানি ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৬ এবং ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে শম্ভু মিত্র ‘চাদবনিকের পালা’ নাটকটি লেখেন বিংশ শতকে এসে মধ্যযুগীয় কাহিনিকে সরাসরি লিখবেন - এটা সম্ভব আশা করা যায় না তাঁর রচনা অভ্যন্তরে কোন না কোন বিশেষ তাৎপর্য থাকবেই সেই ভাবনা চিন্তা থেকেই নাটকের শেষ পর্যন্ত সমাজের কুটিল বিষয়কে তুলে ধরলেন। লখিন্দর, বেহুলা কিংবা চাঁদ সদাগর প্রমূখ প্রত্যেকের আচরণ ও অভিব্যক্তিতে রয়েছে আধুনিক জীবন দৃষ্টি নাটক রচনা কালগত সময়সীমা স্বাধীনতা প্রাপ্তির এক বিশৃঙ্খলিত সময়। অর্থনৈতিক বৈষম্য, নকশাল আন্দোলন, সামাজিক ব্যভিচার, সন্ত্রাস এই সংকটকালীন সময়ে দেখা দিয়েছে অস্তিত্বের সংকট কিংবা ক্ষমতা ধরে রাখার ষড়যন্ত্র নাটকে চাঁদ বিরুদ্ধ শক্তি চাঁদের প্রভাব-প্রতিপত্তিকে খর্ব করার জন্য সবরকম ব্যবস্থা করেছে

সমকালীন উত্তাল রাজনৈতিক আবহে চাঁদের আদর্শবাদী বিদ্রোহ নিস্ক্রিয় হয়ে গেছে। চাঁদের বিরুদ্ধে বেণীমাধবের দল আপাতদৃষ্টিতে জয়ী হয়েছে প্রত্যেকটি ক্ষমতালিপ্সু মানুষ একে অপরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে সমকালীন রাজনৈতিক আবহের মতোই। রাজনৈতিক বা দলগত ভাবে বিভাজিত হয়ে চম্পকনগরকে দলাদলি, স্বার্থপরতায় এক অন্ধকার জগতে ঠেলে দিয়েছে। বল্লভাচার্য, বেনিনন্দন ও করালির দল রাজনৈতিক কূটকৌশলে চম্পকনগরকে বিশ্লেষণ করতে চেয়েছে।  পারস্পরিক দলাদলিতে ‘জগতে যেন এক অকাল নেমেছে সেখানে জ্ঞানের সম্মান নাই, বিদ্যার মর্যাদা নাই, সুভদ্র আচার নাই, সুভাষণ নাই, মাংস সুখ ছাড়া অন্য কোন সুখ চিন্তা নাই”। সংসারের যাঁতাকলে পড়ে চাঁদ পানপাত্র হাতে নিয়েছে সূরাপায়ী হয়ে উঠেছে সে নিজে নিজেকে চিনতে পারেনি। সে বলেছে – ‘এই চাঁদ, সেই চাঁদ নয়, ঠিক! আজিকার এই চম্পক নগরী; আমার সে যৌবনের চম্পক নগরী নয়; যার তরে পাড়ি দিয়েছিনু’। এইভাবে যৌবনের অগ্রদূত, শিবের পূজারী চাঁদ শেষ পর্যন্ত অন্ধকারে নিমজ্জিত হলো সে দিক থেকে নাটকটিকে অন্ধকারের পাঁচালী হিসেবে অভিহিত করা যায়। কিন্তু চাঁদের আজীবন চেষ্টা অন্ধকারকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। আশার আলোর পথ দেখিয়েছে। “শুধু এট্টা পথ আছে”। লখিন্দরকে সে পথ নিতে বলেছে। তাঁকে বীর হতে বলেছে। বংশের একমাত্র ভবিষ্যৎ হিসেবে সমুদ্রে পাড়ি দিতে বলেছে। আবার জীবনের সন্ধান করতে বলেছে।

বল্লভাচার্য, বেনি নন্দন এবং করালিদের মতো দেবী মনসাও এখানে অন্ধকার অজ্ঞানতার দেবী হিসেবে চিহ্নিত পাতাল বাসিনী, আন্ধার নাগিনী এই অন্ধকার অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে চাঁদ সওদাগর একাই লড়ে অর্থাৎ সত্য শিব সুন্দরকে প্রতিষ্ঠা করার দৃঢ় সংকল্প নিয়েছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত দৃঢ়তা ধরে রাখতে পারেনি। “চন্দ্রধর মহৎ কাজের কথা ভুল্যে যাও শুধু কোনমতে নিজেরে বাঁচেয়া রাখো। আদর্শের পাছে ছুট্যে কোন লাভ নাই’’।ল্লভের এই পরামর্শ কর্ণপাত না করা চাঁদের শেষ জীবনে করুণ পরিণতি নেমে আসে

নাটকটিতে প্রত্যেকটি চরিত্র আলাদা আলাদা দৃষ্টিকোণ থেকে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা লড়াই করেছে চাঁদ লড়াই করেছে সততা ও যৌবনকে রক্ষা করার জন্য সনকা স্বামী-সংসার নিয়ে সুখে থাকতে যুক্তির অতীত জ্ঞানের অতীত আর আলোর অতীত মনসার সেবা করেছে অন্যদিকে বল্লভাচার্য, বেনিনন্দন ও করালিরা নিজেদের স্ব-স্ব স্থানে টিকে থাকতে নানান ষড়যন্ত্র করেছে আবার তাদের পাতা জালে নিজেরাই ফাঁদে পড়েছে। শত ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও চাঁদ সদাগর জীবিত থাকতে চেয়েছে। চম্পকনগরের জন্য সুদুরে পাড়ি দিবে যতদিন বাঁচবে সে পাড়ি দিবেই। তাই নাটকের শেষে সব কিছু বেচে দিয়ে পাড়ি দেওয়ার জন্য উৎসুক হয়ে উঠেছেসে নিজের জন্যে পাড়ি জমাতে চায়নি, সম্পূর্ণ চম্পকনগরের জন্যই এই পাড়ি জমাতে চেয়েছে তাই চাঁদের স্বগতোক্তি –“চম্পকনগরী তুই কিছু কবিনাক? কিছু করি নাই আমি তোর তরে? এই পথ ঘাট গাছ পালা বাড়ি – তোরা কিছু কবি নাক?”

অন্যদিকে দাম্ভিক বেনিনন্দন ক্ষমতার লোভে চম্পকনগরীর আলো চাঁদকে পাড়ি দিতে বাধা দিয়েছিল। এখন সেই নিজের ছেলের হাতে উৎখাত হয়েছে নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাস এ যে একদিন ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখতে ষড়যন্ত্রের জাল বুনেছিল, সে আজ তারই চালে ছটফট করছে ভুলুয়ার কথায় “ঐ বেনিনন্দনের বিশ্বাসের ভৃত্য ছিল যারা, তারা ঐ বনের ভিতর দিয়্যা অন্য রাজ্যে পালালো এখনই সেই যে সুবল বেনিনন্দনের ছেল্যে সে নাকি নিজেকে নাকি নিজের বাপের হত্যা কর‍্যা সিংহাসন কেড়্যে নিয়েছে”।

খিন্দর-বেহুলা যুগ যন্ত্রণারই ফসল। কেননা মনসা মঙ্গলে বেহুলা স্বামী উদ্ধার করে। তাদের মিলন হয়। তাদের স্বর্গারোহন হয়। কিন্তু নাটকে বেহুলা-লখিন্দর আত্মহত্যা করে। তাদের আত্মহত্যা আমাদের ভাবিয়ে তোলে কিংবা পিতার অবর্তমানে মায়ের উপর কলঙ্ক এবং সবার ব্যঙ্গ বিদ্রুপ লখিন্দর সহ্য করতে পারেনি লজ্জায় ঘৃণায় তার মাথা নত হয়ে গেছে পালিয়ে বেড়ালেও নিজেকে সঠিক জবাব দিতে পারেনি যদিও লখিন্দর স্বাভাবিক অবস্থায় অনুশোচনা করেছেন। বলেছেন – “ব্যঙ্গ কর‍্যা কয়্যেছি যে, পিতৃপুরুষেরা অদ্ভূত পৃথিবী এক রেখ্যে গেছে আমাদের তরে। আজ মনে হল, তারাওতো এর চায্যা ভালো কোনো পৃথিবীরে পায় নাই। তাই আমারে মার্জনা করো। তুমি পুনর্বার পাড়ি দেও পিতা”।  বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে লখিন্দর শেষ পর্যন্ত পিতাকে বুঝতে পারে। লখিন্দরের এই জীবন দৃষ্টি মনসামঙ্গলে নেই। মঙ্গলকাব্যের ধারাবাহিক বৈশিষ্ট্যকে ছাপিয়ে আধুনিক করে তুলেছেন।

 তাকে অনেকটাই প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে অন্যদিকে বেহুলা বিবাহ পরবর্তী জীবনে মৃত স্বামীকে পুনরুদ্ধার করে। তাঁকে পুনরুদ্ধার করেও স্বস্তিতে থাকতে পারেনি কারণ তেত্রিশ কোটি চোখের সম্মুখে লাস্য নৃত্য করেছে বেহুলা অজস্র লোকের প্রতি কটাক্ষ করেছে ঘাগড়া সরায়ে উরুদেশ দেখায়েছে, কাঁচুলি শিথিল কর‍্যা লজ্জাহীনা লাস্য নৃত্য করেছে। দ্বিধাহীনচিত্তে বেহুলা এই কথাগুলি বলতে পেরেছে

বেহুলার এই আচরণ অনেকটা অশ্লীল, অনেকটা বেহায়াপনা মনে হয়েছিল বলে নিজেকে নিজের কাছে মেনে নিতে পারেনি কাজটি করেছিল শুধু লখিন্দরকে চম্পকনগরে ফিরিয়ে দিতেঅবশেষে আত্ম অনুশোচনায় তাদের যুগলবন্দি আত্মহত্যা শম্ভু মিত্র মঙ্গলকাব্যের ধারার বাইরে গিয়ে আধুনিক যুগ যন্ত্রণার আত্ম সংকটে ভোগা মানুষকে চিহ্নিত করলেনবেহুলা যেমন আত্ম অনুশোচনায় বেঁচে থাকার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলেছে তেমনি লখিন্দর কালিমালিপ্ত নারীতে বেঁচে থাকার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলে। ফলে দুজন দুজনার মধ্যে আত্ম অনুশোচনা ও বেঁচে থাকার প্রেরণা থেকে মুক্তি পেতে আত্মহত্যার পথকে বেছে নিয়েছে তাদের বেঁচে থাকার সার্থকতা খুঁজে না পাওয়ার মতো আধুনিক মানুষেরা আত্মিক সংকট থেকে মুক্তি পেতে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়

 

সহায়কগ্রন্থ

চাঁদ বণিকের পালাঃ শম্ভু মিত্র, এম. সি. সরকার অ্যান্ড সন্স প্রাইভেট লিমিটেড, ১৪ বঙ্কিম চাটুজ্যে স্ট্রিট, কলিকাতা – ৭৩।

 

No comments

Powered by Blogger.