বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি - জীবনানন্দ দাশ
বাংলার
মুখ আমি দেখিয়াছি
জীবনানন্দ
দাশ
________________________________________________________
১। অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর
ক) ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’ কোন কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত?
উত্তরঃ ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’ কবিতাটি ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত।
খ) ডুমুর গাছের পাতার নিচে কবি কোন পাখিকে
বসে থাকতে দেখেছিলেন?
উত্তরঃ ডুমুর গাছের পাতার নিচে কবি ভোরের
দোয়েল পাখিকে বসে থাকতে দেখেছিলেন।
গ) শ্যামা কি?
উত্তরঃ শ্যামা হল বাংলার এক ধরনের কালো রঙের পাখি।
২। সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর
ক) ফণীমনসার ঝোপে শটিবনে কিসের ছায়া
পড়েছিল?
উত্তরঃ কবি ফণীমনসার ঝোপে শটিবনে বাংলার অপরূপ রুপ
সৌন্দর্য দর্শন করেছেন। ফণীমনসার ঝোপে
শটিবনে জাম-বট-কাঁঠালের-হিজলের-অশত্থ প্রভৃতি গাছের ছায়া
পড়েছিল।
খ) ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়েছি’ কবিতায় উল্লেখ আছে এমন অন্তত তিনটি গাছের নাম লেখ।
উত্তরঃ ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’ কবিতায় উল্লেখিত গাছগুলি হল
জাম-বট-কাঁঠালের-হিজল-অশত্থ- ডুমুর ইত্যাদি।
গ) ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’ কবিতায় উল্লেখ আছে এমন তিনটি পাখির নাম লেখ।
উত্তরঃ ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’ কবিতায় উল্লেখিত তিনটি পাখি হলো দোয়েল, শ্যামা ও খঞ্জনা।
৩। দীর্ঘ প্রশ্ন উত্তর
ক)
‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়েছি’ কবিতা অবলম্বনে কবির অনুভূতি তোমার নিজের ভাষায় ব্যক্ত করো।
উত্তরঃ কবি জীবনানন্দ দাশ প্রকৃতির কবি। রূপসী বাংলার কবি। ‘বাংলার
মুখ আমি দেখিয়াছি’ কবিতাটি ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত। এই কাব্যের প্রত্যেকটি
কবিতায় সুজলা সুফলা বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি দেখা
যায়। তার কাছে বাংলাদেশ পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান। একজন প্রেমিক তার প্রেমিকার সৌন্দর্য্যে যেভাবে আচ্ছন্ন হয় সেভাবে কবি বাংলার রূপ ও
সৌন্দর্যে আচ্ছন্ন হয়ে পরেছেন। বাংলার রূপ
সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে পৃথিবীর রূপ খূঁজতে চান
না। কবি বাংলার প্রকৃতি ও লোকসংস্কৃতির মিলনে ‘The beauty of this earth is
unending.’ এর সৌন্দর্যানুভুতিতে কবিতাটিতে
করুণরসের সৃষ্টি করেছেন।
বাংলার নিসর্গ প্রকৃতির সৌন্দর্য অতুলনীয়। তাই কবি পৃথিবীর সৌন্দর্য দেখতে ইচ্ছুক নন। ডুমুরের
গাছে ছাতার মতো বড় পাতাটির নিচে ভোরের দোয়েল পাখি এসে বসে। জাম-বট-কাঁঠাল-হিজল-অশত্থ গাছের ছায়া ‘ফণীমনসার
ঝোপে শটিবনে’ বিস্তৃত হয়েছে। বাংলার এই অপরূপ
রূপ সৌন্দর্য প্রকৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। বাংলার প্রাকৃতিক
সৌন্দর্য লোকসংস্কৃতির সঙ্গে মিশে অপরূপ
সৌন্দর্য তৈরি করে। মনসা মঙ্গলের অন্যতম নায়ক চাঁদ সওদাগর
চম্পকনগরের কাছে মধুকর ডিঙা নিয়ে যাওয়ার সময় জাম-বট-কাঁঠাল-হিজল-অশত্থ গাছের ছায়ানিবিড় বাংলার
এই অপরূপ সৌন্দর্য দেখেছিলেন।
‘মধুকর ডিঙা থেকে না জানি সে কবে চাঁদ চম্পার কাছে
এমনই
হিজল-বট-তমালের নীল ছায়া বাংলার অপরূপ রূপ
দেখেছিলো;’
গাঙুরের জলে ভেলা ভাসিয়ে বেহুলাও স্বামীর
মৃতদেহকে নিয়ে অমরাবতীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। ভেলায় ভাসতে
ভাসতে কৃষ্ণা-দ্বাদশীর জোৎস্না রাতে বাংলার সোনালী ধান, অসংখ্য অশ্বত্থ, বট গাছগুলিকে অনুভব
করেছে। শ্যামা পাখির মিষ্টি মধুর গান শুনেছে। বেহুলা মৃত স্বামীকে বাঁচানোর জন্য অমরাবতীতে
পৌঁছে ছিন্ন খঞ্জনার মতো নেচেছে। ইন্দ্রের
সভায় বেহুলার নাচে বাংলার নদী মাঠ ভাঁটফুল অর্থাৎ বাংলার
সমগ্র প্রকৃতি যেন বেহুলার দুঃখে দুঃখী হয়েছে। এইভাবে মানুষ ও
প্রকৃতি একাত্ম হয়ে জীব জগতের চরম সত্যকে ব্যঞ্জিত করেছে। একজন দক্ষ
চিত্রশিল্পীর মত বাংলার প্রকৃতিতে জীবনানন্দ দাশ চিত্রকরের
পরিচয় দিয়েছে।
খ) ব্যাখ্যা কর।
‘একদিন অমরায় গিয়ে
ছিন্ন
খঞ্জনার মতো যখন সে নেচেছিল ইন্দ্রের সভায়
বাংলার
নদী মাঠ ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো তার পায় কেঁদেছিল পায়’।- ব্যাখ্যা করো।
উত্তরঃ আলোচ্য উদ্ধৃতাংশটি কবি জীবনানন্দ
দাশের ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’
কবিতার অন্তর্গত। মনসামঙ্গল কাব্যের বেহুলার দুঃখ কষ্ট
ও তার প্রতি প্রকৃতির সহানুভূতিশীলতা প্রসঙ্গে এই অংশটি ব্যাবহার হয়েছে।
বেহুলা মৃত স্বামীর প্রাণ ফিরে পেতে গাঙুরের জলে ভাসতে ভাসতে একদিন অমরাবতীতে গিয়ে পৌঁছায়। সেখানে দেবরাজ ইন্দ্রকে নৃত্যে সন্তুষ্ট করে স্বামীর জীবন
ফিরে পেয়েছিলেন। স্বামীর জীবন ফিরে পেতে বেহুলা যেমন দুঃখে
কাতর হয়েছে তেমনি ছিন্ন খঞ্জনা পাখিও ছটফট করে। বেহুলার নৃত্যের সঙ্গে বাংলার নদী মাঠ ভাঁটফুল অর্থাৎ প্রকৃতির স্পন্দন যুক্ত হয়েছে। এক কথায় মৃত
স্বামীর প্রাণ উদ্ধারে বেদনাহত বেহুলার দুঃখে দুঃখী হয়ে বাংলার নদী মাঠ ভাঁটফুল
তার ঘুঙ্গুর শব্দের সঙ্গে এক হয়ে গিয়েছে। বাংলার প্রকৃতি তার
দুঃখে দুঃখী হয়েছে।
টীকাঃ
ক) গাঙুর
গাঙুর একটি
গ্রাম্য নদীর নাম। মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যে এই কাল্পনিক নদীর উল্লেখ আছে। এই নদীর উপর দিয়ে
ভেলা ভাসিয়ে বেহুলা তার মৃত স্বামীকে নিয়ে স্বর্গের
উদ্দেশ্যে ভেসে গিয়েছে।
খ) চম্পা
এখানে চম্পা বলতে মনসামঙ্গলে উল্লিখিত ব্যাবসা বানিজ্যে উন্নত
চম্পক নগরকে বলা হয়েছে। এটি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার একটি প্রাচীন
রাজ্য হিসেবে পরিচিত। মনসামঙ্গল কাব্যের চাঁদ সওদাগর এই
রাজ্যে বাস করেন। ইতিহাসে উল্লেখ আছে প্রাচীন ও মধ্যযুগের
বাংলার বণিক সম্প্রদায় এখানে বাণিজ্য করতে যেতেন।
গ) শটিবন
শটিবন বলতে বাংলার হলুদ জাতীয় এক ধরনের গাছের
বনকে
বোঝানো হয়েছে। এর মূল থেকে এক ধরনের পুষ্টকর
শিশু খাদ্য তৈরি হয়।
ঘ) চাঁদ
চাঁদ সওদাগর মনসামঙ্গল কাব্যের নায়ক চরিত্র। চম্পকনগর এর অন্যতম বণিক। তিনি শিবের উপাসক ছিলেন। মনসার পূজা না করায় সমস্ত ধন-সম্পদ
ও পুত্রদের একে একে হারিয়ে ফেলে। অবশেষে পুত্রবধূ বেহুলার প্রচেষ্টায় এবং মনসার পূজা প্রচারের মধ্যে দিয়ে সব ফিরে পায়।
ঙ) বেহুলা
মধ্যযুগের ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যের অন্যতম নারী চরিত্র বেহুলা। তিনি সায়বেনের মেয়ে। চাঁদ
সদাগরের পুত্রবধূ ও লখিন্দরের পত্নী। দেবী মনসার পূজা
প্রচারের বিরোধিতা করে চাঁদ সদাগর নিঃস্ব হলে বেহুলার চেষ্টাতেই সব ফিরে পায়।
চ) মধুকর ডিঙ্গা
বণিক সদাগরের বাণিজ্যতরীকে মধুকর ডিঙ্গা বলে। মনসামঙ্গল কাব্যে চাঁদ সদাগরের
বৃহৎতরীর নাম ছিল মধুকর। সে তরী নিয়ে ব্যাবসা বানিজ্য
করতেন।
ছ) রূপসী বাংলা
জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলা গ্রন্থাকারে
প্রকাশিত হয় ১৯৫৭ সাল কলকাতার সিগনেট প্রেস থেকে। ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থে সুজলা সুফলা বাংলাদেশের বর্ণনা আছে। তার কাছে
বাংলাদেশ পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান। বাংলাদেশের রূপ সৌন্দর্যকে কবি প্রত্যেকটি
কবিতায় মমতা দিয়ে তুলে ধরেছেন ।
*************************************************************
No comments