Header Ads

কে বাঁচায়, কে বাঁচে!: জীবন পরিচালনার উৎকৃষ্ট উদাহরণ

 



মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের

কে বাঁচায়, কে বাঁচে!: জীবন পরিচালনার উৎকৃষ্ট উদাহরণ

Dr. Paritosh Roy

Contact No. – 9706721988

 

Abstract:

পৃথিবীতে প্রত্যেকেই সুখি হতে চায়। সুখ, শান্তি ও সার্থকতা পেতে চায়। মানুষ সুখ শান্তির খোঁজেই প্রতিনিতই সংগ্রাম করে। সংগ্রামের জন্যই নানা পদ্ধতি বা কৌশল আবিষ্কার করে। সেগুলি ব্যবহার করে জীবনকে সংকটময় পরিস্থিতি থেকে আরামদায়ক বানানোর চেষ্টা করে জীবনকে আরামদায়ক করার লক্ষ্যে যে কৌশলগুলি ব্যবহার করে, সেই কৌশলগুলিকে বলায় জীবন দক্ষতা জীবনকে সহজ সুন্দর ও নিরাপদ করার লক্ষ্যে এই কৌশলগুলি ব্যবহার করা হয়। “কে বাঁচায়, কে বাঁচে!” গল্পে মৃত্যুঞ্জয় ও নিখিল দুজনেই জীবনে সুখী হতে চেয়েছিল। জীবনের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সংগ্রাম করে জীবনকে সহজ সরল ও নিরাপদ করতে চেয়েছিল। তবে মৃত্যুঞ্জয় জীবন পরিচালনায় ব্যর্থ হয়েছে অন্যদিকে নিখিল জীবন পরিচালনায় সার্থকতা খুঁজে পেয়েছে এই প্রবন্ধে জীবনের সফল ও ব্যর্থতার আলোচনায় জীবনের সংগ্রামকে নির্দেশিত করা হয়েছে। জীবনের কঠিন পরিস্থিতিতে সঠিক পথ খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে

 

Key Words:

মানুষ, জীবন দক্ষতা, জীবিকা অর্জনের দক্ষতা, মৃত্যুঞ্জয়, নিখিল, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সফল, ব্যর্থতা, সংকট, প্রতিকূল পরিস্থিতি।

 

মানুষ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব। চেষ্টা, বুদ্ধি ও সহিষ্ণুতা বলে মানুষ পৃথিবীর রাজা হয়েছে নিত্যনতুন কৌশল আবিষ্কার করে জগতের প্রাণিকুলের থেকে নিজেকে আলাদা করেছে। প্রতিকূল জগৎ সংসারকে নিজের মতো করে ব্যবহার করতে চেয়েছেকিন্তু সমাজ সংসার প্রতিদিন একই সরলরেখায় চলেনা। জীবনের চলার পথে অনেক বাঁক নিতে হয়। বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে মানুষকে জীবন যাপন করতে হয়। ভালোভাবে বেঁচে থাকার তাগিদে প্রত্যেকটি মানুষই নানারকম সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে চলেছে চলার পথে নানাভাবে বিপদগ্রস্ত হয়েছে। কিংবা সংকটে পড়ে আর সেই সংকট মোকাবিলা করতে গিয়ে কখনো সফল হয় আবার কখনো বিফল হয়আবার কোন কোন সময় বিভ্রান্ত ও দিশেহারা হয়ে পড়ে

আমরা জানি, সমাজ নিয়ত পরিবর্তনশীল সময়ের হাত ধরে প্রতিনিয়ত মানুষ কোন না কোন সমস্যার সম্মুখীন হয় বেঁচে থাকার তাগিদেই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কঠোর পরিশ্রম করে সময়ের সাথে পরিবর্তিত সমাজের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ নেয়। পারিপার্শ্বিককে চ্যালেঞ্জও দেয়। এই চ্যালেঞ্জ বা সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে মানুষ নানা ধরনের কৌশল আবিষ্কার করে। প্রতিটা মুহূর্তে বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে সুস্থ, সুন্দর ও নিরাপদ জীবন-যাপন করতে চায়। তাই সুস্থ, সুন্দর ও নিরাপদ জীবন-যাপনের লক্ষে ব্যাবহৃত কৌশল বা পদ্ধতি গুলিকে জীবন দক্ষতা বলা যায়। অর্থাৎ সুস্থ, সুন্দর ও নিরাপদ জীবন যাপন করার কৌশলগুলি হল জীবন দক্ষতা বা (Life Skill)। এই দক্ষতাগুলি যার যত বেশি শক্তিশালী হয়, সে ততো বেশি প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে সক্ষম হয় এই দক্ষতাগুলিকে প্রকাশে বা ব্যবহারে মানসিক দৃঢ়তা ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিগুলি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) জীবন দক্ষতা বলতে সেই রকম কথাই বলেছেন তারা বলেছে

“Life skills are abilities for adaptive and positive behaviours that enables individuals to deal effectively with the demands and challenges of everyday life.”

প্রত্যেকটা মানুষ ঘুম থেকে উঠে ঘুমিয়ে যাওয়া পর্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে, নিজের মতো করে তাকে সংকট বা চ্যলেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে তাকে প্রতিনিয়ত জীবনের নানা সংকট ম্যানেজ করেই জীবনকে পরিচালনা করতে হয় বর্তমানে স্ট্রেসের যুগে কারো খাওয়া ভালো হতো রাতে ঘুম ভালো হয় না কারো প্রচুর অর্থ সম্পদ আছে, তো জীবনে সুখ শান্তি নেই অস্থিরতায় দিন কাটে কারো সন্তান সন্ততি নানা কারণে ছেড়ে চলে গেছে, প্রেমিক প্রেমিকা কিংবা দুশ্চিন্তা কোন না কোন কিছু লেগেই থাকে। অনেকে তো বিনা কারনেই দুশ্চিন্তা করতে থাকে। যা মানুষকে বিপদগ্রস্ত করে তোলে সুস্থ, সুন্দর ও নিরাপদ জীবন যাপন করতে দেয় না। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে মানুষ সেই অভাব পূরণ করার জন্য তার নিজের অভাবকে বা কমতিকে দূর করার জন্য নানা পরিকল্পনা করে সুস্থ, সুন্দর ও নিরাপদ থাকার জন্য নানা কৌশল গ্রহণ করে সেই কৌশলগুলি হল জীবন দক্ষতা সেই দিক থেকে জীবন দক্ষতা বুদ্ধিগত এবং সমাজগতও বটে। কারন জীবন পরিচালনার কৌশলগুলি বুদ্ধির সাহায্যে যেমন নেওয়া হয় তেমনি সমাজের সঙ্গে তালমিলিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।

তাহলে জীবন দক্ষতা বলতে বোঝায়, এমন কতগুলো দক্ষতা বা কৌশল যা কাজে লাগিয়ে মানুষ বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে প্রতিদিনকার জীবনের চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবিলা করে জীবনের বিপদ সংকটগুলোকে কমিয়ে এনে জীবনকে বিপদমুক্ত করতে সক্ষম হয় জীবনকে সুন্দরভাবে পরিচালনা করে সমাজে সার্থকতা পেতে চেষ্টা করে

আমার আলোচ্য গল্পটির নাম কে বাঁচায়, কে বাঁচে!”। লিখেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৩৫০ সালের দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটে লেখা এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হলো নিখিল এবং মৃত্যুঞ্জয়নিখিল এবং মৃত্যুঞ্জয় দুজনের জীবন পরিচালনায় আমরা দেখব - কে কতটা দক্ষতার সঙ্গে জীবন পরিচালনা করতে সক্ষম হয়েছে আদৌ তারা প্রত্যেকে সফল হয়েছে না ব্যর্থ হয়েছে, তারা তাদের জীবন দক্ষতাগুলো পরিবর্তিত সময় ও সমাজে কীভাবে ব্যবহার করেছে? এবং তার থেকে মুক্ত হতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন ছিল? তাদের জীবন ও চরিত্র আলোচনা করে একটি সঠিক পর্যালোচনা করা হবে।

তার আগে গল্পটার বিষয়সংক্ষেপ একটু বলে নেওয়া দরকার নিখিল এবং মৃত্যুঞ্জয় দুজনেই ছিল শিক্ষিত, শহুরে ব্যক্তি। অফিসে চাকরি করে চাকরির কারণে বাসে ট্রামে তাদের বেশি যাতায়াত করতে হয় বাইরের পরিবেশের সঙ্গে তেমনটা যোগাযোগ নেই যোগাযোগ থাকলেও পেপার পত্রিকাতেই গণ্ডিবদ্ধ কিন্তু হঠাৎ একদিন মৃত্যুঞ্জয় ফুটপাত ধরে হাটতে গিয়ে এক ক্ষুধার্ত মানুষের মৃত্যু দেখে ফেলে তাকে দেখে মৃত্যুঞ্জয়ের শারীরিক এবং মানসিক পরিবর্তন ঘটে অন্যদিকে নিখিল তাকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে সে বিফল হয় নিখিলের অনুরোধ সত্বেও মাইনের সব টাকা রিলিফ ফান্ডে জমা করে দেয় এক বেলা খাবার না খেয়ে খাবার দান করে দেয় নিজে না খেয়ে খাবার বিলিয়ে দিয়ে সে অপরকে বাঁচানোর চেষ্টা করে খাবার বিলিয়ে দিয়ে অপরকে বাঁচানো যে সম্ভব নয়, নিখিল তাকে ভালোভাবে বোঝাতে থাকে। কিন্তু নিখিল কথার কোনো গুরুত্ব দেয় না শেষে নিজেও বাঁচতে পারে না, অন্যদেরকেও বাঁচাতে পারে না। অর্থাৎ সে জীবন সংগ্রামে ব্যর্থ হয়।

এই গল্পে মৃত্যুঞ্জয়ের পরিণতি খুবই করুণ হয়েছে অন্যদিকে নিখিল পরিবার-পরিজন নিয়ে মৃত্যুঞ্জয়ের থেকে কম বেতনে সুখে সংসার যাপন করতে সক্ষম হয়েছে এই প্রসঙ্গে বলে নেওয়া ভাল, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) মানুষের  ১০ টি জীবন দক্ষতাকে নির্দেশ করেছে সেগুলি হল - আত্ম সচেতনতা, সহমর্মিতা, আন্তঃব্যক্তিক দক্ষতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা, বিশ্লেষণমূলক সুস্থ চিন্তন দক্ষতা, আবেগ সামলানোর দক্ষতা ও চাপ মোকাবিলার দক্ষতা একজন ব্যক্তি এই দক্ষতাগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকলেই তার চ্যালেঞ্জ বা সংকট মোকাবিলায় সুবিধা হয়। এই দক্ষতাগুলিকে বিশ্লেষণ করে গল্পের উল্লিখিত চরিত্রগুলিকে বিশ্লেষণ করা হবে

গল্পের নিখিল আর মৃত্যুঞ্জয় একই মুদ্রার দুই পিঠ মৃত্যুঞ্জয় ফুটপাথে প্রথম মৃত্যু দেখল অনাহারে মৃত্যু অনাহারে মৃত্যু দেখেই মৃত্যুঞ্জয় রীতিমতো কাবু হয়ে পড়েছে শারীরিক ও মানসিকভাবে কষ্টবোধ করেছে সে আদর্শবাদী অফিসে চাকরি করে এককথায় শিক্ষিত, অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তি কিন্তু তার আত্মসচেতনতার অভাব রয়েছে নিজেকে ও নিজের পারিপার্শ্বিককে বুঝতে ভুল হয়েছে জীবনের কঠিন চ্যালেঞ্জের বা সংকটের মোকাবিলা করতে গিয়ে ভুল পথে পরিচালিত হয়েছে তার জীবন দক্ষতা নেই এটা বলা সঙ্গত নয় কারণ সহমর্মিতা তার জীবনে ছিল বলেই ফুটপাথে দেখা অনাহারে মৃত্যুর জন্য সহমর্মি হয়েছে। তাদের জন্য কিছু করতে চেয়েছে অন্যদিকে আমরা নিখিল চরিত্রটি বিশ্লেষণ করি, তাতে দেখতে পাবো সে আত্মসচেতন সে সহমর্মী, সে আত্মসচেতন বলেই মৃত্যুঞ্জয়কে বোঝাতে চেয়েছে ফুটপাথের মৃত্যুটা তেমন কোন বড় ব্যাপার না। পৃথিবীতে এরকম কত শত ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটে থাকে সে সহমর্মী বলে অফিসের সহকর্মী মৃত্যুঞ্জয়ের শারীরিক ও মানসিক কষ্টবোধ দেখে নিজেও কষ্ট বোধ করে। তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে অভয় দিয়েছে, সহযোগিতা করেছে, তার জীবনের বিকৃত পরিস্থিতিকে কমিয়ে এনে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছে

মৃত্যুঞ্জয়ের আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগের দক্ষতার অভাব ছিল। সংকটকালীন পরিস্থিতিকে সঠিক ভাবে বিশ্লেষণ করতে পারেনি এইজন্য ক্ষুধা-তৃষ্ণায় অর্থাৎ অনাহারে মৃত্যুর কথা ভেবেই মৃত্যুঞ্জয় নিজেকে অপরাধী ভেবেছে। মৃত্যুঞ্জয় তাদের অনাহারে থাকা থেকে মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সঠিক ও উপযুক্ত বিশ্লেষণ না করেই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে

ভাবছি আমি বেঁচে থাকতে যে লোকটা না খেয়ে মরে গেল এ অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত কী? জেনেশুনেও এতকাল চার বেলা করে খেয়েছি পেট ভরে”।

 এই অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত তাকে পরিণতির দিকে ঠেলে দেয় সে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয় ফুটপাথের অনাহারে থাকা মানুষদের বাঁচানোর। মাইনের সমস্ত টাকা রিলিফ ফান্ডে জমা করে দেয় বাড়িতে জন সদস্য, মাস পেরোলেই তাকে ধার করে সংসার চালাতে হয় তা সত্ত্বেও সে মাইনের সমস্ত টাকা রিলিফ ফান্ডে জমা করে দিল পরিবারের করুণ পরিস্থিতির কথা জেনেও একটি সুস্থ চিন্তা ভাবনা না করেই একপ্রকার বিশ্লেষণহীন সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে মৃত্যুঞ্জয় অন্যদিকে নিখিল খুবই হিসেবে তার জীবনের দক্ষতাগুলি সঠিক সময়ে সঠিকভাবে প্রয়োগ করে সফল হয় সুস্থ জীবন যাপন করতে সক্ষম হয় মৃত্যুঞ্জয় অনাহারে মৃত্যু দেখে অসুস্থ অস্থির সিদ্ধান্ত নেয় আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগের মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয় না। সুস্থ চিন্তা ভাবনা না করে নিজের জীবনকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়। মৃত্যুঞ্জয়কে নিখিল বুঝিয়েছে

এভাবে দেশের লোককে বাঁচানো যায় না”। কিংবা বেঁচে থাকতে যতটুকু খা এবং দেশের সমস্ত লোক মরে গেলেও সেইটুকু সংগ্রহ করার ক্ষমতা আমার থাকে, কাউকে না দিয়ে নিজেই আমি তা খাব নীতি ধর্মের দিক থেকে বলছি না, সমাজ ধর্মের দিকে থেকে বিচার করলে ১০ জনকে খুন করার চেয়ে নিজেকে না খাইয়ে মারা বড় পাপ”।

এইসব কথা শুনে মৃত্যুঞ্জয় নিখিলকে পাগল বলে আসলে মৃত্যুঞ্জয় পাগল তার পরিচয় পাওয়া যায় মৃত্যুঞ্জয়ের পরবর্তী আচরনেমৃত্যুঞ্জয় নিজেকে বুঝতে পারেনি আবেগের দ্বারা চালিত হয়ে ন্ধ হয়ে গেছে সে ফুটপাথের অনাহারক্লিষ্ট মানুষদের প্রতি এতটাই আবেগ তাড়িত হয়েছে যে তাদের দিক থেকে মন-মানসিকতা আলাদা করতেই পারেনি। তাদের সঙ্গে এক হয়ে গিয়েছে। তাদের মতোই সে হয়ে গিয়েছে অনাহারক্লিষ্ট ফুটপাবাসীদের থেকে নিজেকে আলাদা করতে পারেনি প্রতিটা মুহূর্তেই তাদের কথা সে ভেবেছে, সে বলেছে

আমায় কিছু একটা করতে হবে ভাই রাতে ঘুম হয় না, খেতে বসলে খেতে পারিনা”।

এই কথায় মৃত্যুঞ্জয়ের যৌক্তিকতা থাকলেও আবেগটাই বেশি কাজ করেছে। শেষে আবেগের বশেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিচার-বুদ্ধি দিয়ে জীবন ও তার চারপাশকে বিশ্লেষণ না করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অন্যদিকে নিখিল তাকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে কিন্তু স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় নিখিল বিফল হয়। সে বিফল হয়ে শেষে টুনুর মায়ের কাছে গিয়ে বিষয়টা বিশ্লেষণ করে। নিখিল সেখানেও ব্যর্থ হয় কারণ টুনুর মা অসুস্থ সেও সময় দিতে পারেনা মৃত্যুঞ্জয়কে উপরন্তু মৃত্যুঞ্জয় তাকে ম্যানেজ করে নিয়েছে টুনুর মার ভাবনাও মৃত্যুঞ্জয়ের মতই হয়েছে সে বিচার বুদ্ধি হারিয়ে মৃত্যুঞ্জয়কে অকাতরে সমর্থন করেছে সে বলেছে

ওর সঙ্গে থেকে থেকে আমিও অনেকটা ওর মতো হয়ে গেছি”।

অর্থাৎ পরিশেষে মৃত্যুঞ্জয় কোন কূল কিনারা খুঁজে না পেয়ে জীবনের টেনশন বা চাপ মোকাবিলা করতে পারেনি। জীবনের চলার পথে চাপকে মোকাবিলা করতে না পেরে এক অনিশ্চয়তাকে জীবন হিসেবে বেছে নেয় যাকে নিখিল কোনমতে সমর্থন করেনি মৃত্যুঞ্জয় পাগল হয়ে যায় অফিসের কাজ সেরে ফুটপাথের অনাহারক্লিষ্ট মানুষগুলির মত আচরণ করে নিখিলের সমস্ত যুক্তি তর্কের বিশ্লেষণকে সে পাত্তা দেয়না

মৃত্যুঞ্জয় শোনে কিন্তু তার চোখ দেখেই টের পাওয়া যায় যে কথার মানে সে আর বুঝতে পারছে না তার অভিজ্ঞতার কাছে কথার মারপ্যাঁচ অর্থহীন হয়ে গেছে ক্রমে ক্রমে নিখিলকে হাল ছেড়ে দিতে হয়”।

পরিশেষে মৃত্যুঞ্জয় পাগল হয়ে যায় ফুটপাথের অনাহারক্লিষ্ট মানুষদের মতোই আচরণ করে অফিসের সমস্ত আদব-কায়দা অদৃশ্য হয়ে যায়

এই গল্প কাহিনী দুটি চরিত্রের বিশ্লেষণে আমরা জানতে পারলাম যে, সংকটকালীন পরিস্থিতিতে জীবন পরিচালনায় জীবন দক্ষতা কতটা জরুরি! সেখানে নিখিল অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সুনিপুণভাবে দক্ষতাগুলি ব্যবহার করেছে বাস্তব পরিস্থিতিকে সচেতনভাবে বুঝেছে, বিশ্লেষণ করে সুস্থ মন মানসিকতায় সিদ্ধান্ত নিয়ে একটি সফল জীবন যাপন করতে সক্ষম হয়েছে অন্যদিকে মৃত্যুঞ্জয় নিখিলের থেকে পঞ্চাশ টাকা বেশি মাইনে পেয়েও জীবন পরিচালনায় ব্যর্থ হয়েছে আদর্শবাদী পুরুষ হয়েও জীবন সংকটকালীন পরিস্থিতিতে অন্যদের বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবনকে ধ্বংস করেছে। সে নিজে জীবন সংকটে পড়েছে, সে অন্যদের বাঁচাতে পারিনি উপরন্তু নিজের জীবনকে ধ্বংস করেছে সঙ্গে পরিবার পরিজনকে ধ্বংস করেছে তবে এই প্রসঙ্গে বলে রাখা প্রয়োজন যে জীবন দক্ষতা ও জীবিকা অর্জনের দক্ষতা এক নয়। জীবন দক্ষতা একেবারেই বৌদ্ধিক এবং সামাজিক। এটি ব্যক্তি এবং সমাজের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সুস্থ ও সুখী জীবন যাপনের জন্য অপরিহার্য। অন্যদিকে জীবিকা অর্জনের দক্ষতা অর্থ উপার্জনের ক্ষমতা অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত। এটি জীবনে প্রয়োজন হলেও অপরিহার্য নয় জীবিকা অর্জনের দক্ষতা উপার্জনের সঙ্গে জড়িত সুস্থ ও সুখী জীবনের জন্য প্রয়োজন হলেও একেবারে অপরিহার্য নয় এটি জীবনের অংশ মাত্র এটা কারিগরি ও বৃত্তিমূলক দক্ষতার সাথে পরিচিত যেমন মৃত্যুঞ্জয় জীবন পরিচালনায় অফিস থেকে উপার্জন করার ক্ষমতা রয়েছে বুদ্ধি ব্যবহার করে সে উপার্জন করতে সক্ষম হয়েছে কিন্তু উপার্জিত অর্থকে সঠিকভাবে ব্যবহার করে জীবনকে পরিচালনা করার ক্ষমতা তার মধ্যে ছিল না বা গড়ে ওঠেনি এতে বোঝা যাচ্ছে, মৃত্যুঞ্জয়ের জীবিকা অর্জনের দক্ষতা রয়েছে কিন্তু জীবন দক্ষতা তেমনভাবে নেই বা পূর্ণতা লাভ করতে পারেনি তাই এখানে মৃত্যুঞ্জয়ের জীবনে জীবিকা অর্জনে দক্ষতা ছিল কিন্তু জীবন দক্ষতা তেমনটা ছিল না, বা জীবন পরিচালনায় দক্ষতার সেই কৌশলগুলি ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারেনি তাই জীবন পরিচালনা সে ব্যর্থ হয় অন্যদিকে নিখিল জীবিকা ও জীবন পরিচালনায় সফল হয় তার থেকে কম বেতন পেয়েও সুস্থ, সুন্দর ও নিরাপদ জীবন যাপন করতে সক্ষম হয় এইজন্য শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় জীবন দক্ষতা (Life Skill) অত্যন্ত প্রয়োজন

গল্পে বর্ণিত মৃত্যুঞ্জয় ও নিখিলের চরিত্রকে বিশ্লেষণ করে বুঝতে পারলাম জীবন পরিচালনায় জীবন দক্ষতা কতটা জরুরী বিশেষত সংকটকালীন চ্যালেঞ্জের পরিস্থিতিতে জীবন দক্ষতাগুলি সঠিক সময়ে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে জীবনে সফল হবে আর সঠিক সময়ে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে না পারলে বিফল হবে এটাই স্বাভাবিক তবে তার মাঝে অবস্থান করলে বিভ্রান্ত হতে হবে সেখানেও জীবন দক্ষতাগুলির উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। তবে মৃত্যুঞ্জয় ও নিখিল দুজনেই জীবনে সফলতা খুঁজেছিল। নিখিলের বিপরীতে মৃত্যুঞ্জয় অনাহারে ফুটপাথের মানুষগুলোকে বাঁচাতে চেয়েছিল কিন্তু তার জীবনে ব্যবহৃত কৌশলগুলি বা দক্ষতাগুলি ব্যবহারে সে বিফল হয়েছে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে শেষে চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে না পারায় পাগল হয়ে গিয়েছে এবং তাদের মতোই আচরণ করা শুরু করেছে এই প্রসঙ্গে নয়ন বিন বাহার সফলতা অর্জনের কয়েকটি ধাপের কথা উল্লেখ করেছেন। সেগুলি হল - জ্ঞান পরিকল্পনা, সমস্যা নির্ধারণ করার ক্ষমতা, সমস্যা সমাধান করার ক্ষমতা, নেতৃত্ব, প্রতিপক্ষের দৃষ্টিকোণ থেকে নিজেকে বিচার করা, অন্যের মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া, ফলাবর্তন এবং ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা এই ধাপগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে জীবনে সফলতা আসবে বা সুস্থ, সুন্দর ও নিরাপদ জীবন যাপন করা সম্ভব হবে

মৃত্যুঞ্জয় যদি ফুটপাথের অনাহারক্লিষ্ট মানুষদের পরিণতির বিষয়টাকে ভালোভাবে জানতে চেষ্টা করত এবং বিভিন্ন উৎস থেকে জ্ঞান আহরণ করে সঠিক পরিকল্পনায় সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করত তাহলে এমন করুণ পরিণতি দেখতে হতো না সেদিন থেকে নিখিল নিজের এবং পারিপার্শ্বিক সম্পর্কে সচেতন ছিল নানাভাবেই জ্ঞান আহরণ করে সঠিক পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে সমস্যা সমাধানে নেতৃত্ব দিয়েছে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার মধ্য দিয়ে সবকিছু বিচার বিশ্লেষণ করেছে তাই সে সফল হয়েছে অন্যদিকে মৃত্যুঞ্জয় নিজের সম্পর্কে তেমন সচেতন ছিল না পারিপার্শ্বিকের একটামাত্র ঘটনাকে কেন্দ্র করে সমস্যা সমাধানে নেমেছে কিন্তু সমস্যা সমাধান করতে গেলে আগে সমস্যাকে নির্ধারণ করতে হয় সেই জ্ঞানটুকু তার ছিল না। বা পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতনতার অভাব ছিল মৃত্যুঞ্জয় অনাহারক্লিষ্ট ফুটপাবাসীকে বাঁচানোর জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ঠিকই কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা, সমস্যা নির্ধারণ ও সমস্যা সমাধান করতে পারেননি সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা ছিল কিন্তু সঠিক পরিকল্পনার অভাবে তার কোন ফিডব্যাক বা ফলাবর্তনের জন্য ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা তার মধ্যে ছিল না সেই কারণে মৃত্যুঞ্জয় নিজেও বাঁচতে পারেনি অন্যদেরকেও বাঁচাতে পারেনি সে সংকটকালীন পরিস্থিতিতে জীবন পরিচালনায় ব্যর্থ হয়েছে একসময় পৃথিবী থেকে হারিয়ে গিয়েছে

 

তথ্যসুত্রঃ

১. World Health Organization (2020): Life skill Education for Children and Adolescents in Schools (Reported), Retrieved 29.

২. সৈয়দ, আব্দুল মান্নানঃ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় শ্রেষ্ঠ গল্প, অবসর, পৃষ্ঠা- ১৫৩।

৩. সৈয়দ, আব্দুল মান্নানঃ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় শ্রেষ্ঠ গল্প, অবসর, পৃষ্ঠা- ১৫৪।

৪. সৈয়দ, আব্দুল মান্নানঃ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় শ্রেষ্ঠ গল্প, অবসর, পৃষ্ঠা-  ১৫৪.

৫. সৈয়দ, আব্দুল মান্নানঃ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় শ্রেষ্ঠ গল্প, অবসর, পৃষ্ঠা- ১৫৫।

৬. সৈয়দ, আব্দুল মান্নানঃ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় শ্রেষ্ঠ গল্প, অবসর, পৃষ্ঠা-  ১৫৫।

 

 

সহায়ক গ্রন্থঃ

১. সৈয়দ, আব্দুল মান্নান : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় শ্রেষ্ঠ গল্প, অবসর

২. সেনগুপ্ত, অচিন্ত্য (১৩৬৬): কল্লোল যুগ : ডি. এম. লাইব্রেরী, কলকাতা।

৩. বনফুল  (১৯৮২) : পশ্চাৎপট : গ্রন্থালয়, কলকাতা।

৪. মান্না, গুণময়  (১৩৯৫) : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রসঙ্গে : জলার্ক।

৫. বসু, বুদ্ধদেব (১৯৪৮): An Acre of Green Grass : ওরিয়েন্টাল লংম্যান্স, কলকাতা।   

 

 

 

 

 

 

______________________________________________________________

2 comments:

Powered by Blogger.